Magic Lanthon

               

লুই লুমিয়ের

প্রকাশিত ১৭ জানুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

‘আমিই সিনেমাটোগ্রাফের মূল স্বত্বাধিকারী’

লুই লুমিয়ের


১৮৯৫ সালের ২২ মার্চ প্যারিসে প্রদর্শন হয় ওয়ার্কারস লিভিং দ্য লুমিয়ের ফ্যাক্টরি। এর মধ্য দিয়েই সূচনা হয় পৃথিবীর বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ইতিহাস। লুই লুমিয়ের ও অগাস্ত লুমিয়ের নামে দুই ভাই ছিলেন এই কৃতিত্বের নায়ক। তাদের বাবা  ফ্রান্সের বিখ্যাত ফটোগ্রাফার ও ব্যবসায়ী আঁতোয়া (Antoine) লুমিয়ের নাকি এডিসনের কিনোটোস্কোপ দেখে ফিরে এসে দুই ছেলেকে বলেছিলেন, তোমরা এর থেকে ভালো কিছু করো। এরপর নিরলস পরিশ্রম ও শত বাধা পেরিয়ে সিনেমাটোগ্রাফ নামের বিস্ময়কর এক যন্ত্র আবিষ্কার করেন দুই ভাই। পরবর্তী সময়ে অবশ্য সিনেমাটোগ্রাফ সংক্রান্ত বেশিরভাগ কাজ এগিয়ে নিয়েছিলেন লুই লুমিয়ের একাই। ১৮৬৪ সালের ৫ অক্টোবর লুই লুমিয়ের জন্মেছিলেন ফ্রান্সের বেসানকন (Besancon) শহরে। পড়াশোনা করেন লিওঁ শহরের সবচেয়ে বড়ো টেকনিকাল স্কুল লা মার্টিনিয়ার (Martiniere) ও পরে কনজারভেটোর ডি লিওঁ (Conservatoire de Lyon)-এ। এরপর লুই বাবার ফটোগ্রাফিক কারখানায় পদার্থবিদ হিসেবে যোগ দেন। আর এখানেই ১৮৯৫ সালে সিনেমাটোগ্রাফ যন্ত্রের আবিষ্কার। তাদের প্রতিষ্ঠান থেকেই সেসময় নির্মাণ হয় প্রায় ৫০টি চলচ্চিত্র। প্রাযুক্তিক উদ্ভাবন দিয়ে চলচ্চিত্রকে এক অসাধারণ উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া মহান এই মানুষটি ১৯৪৮ সালের ৬ জুন ৮৩ বছর বয়সে ব্যান্ডল শহরে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে ফ্রান্স টেলিভিশন সার্ভিসের পক্ষ থেকে তার জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারটি নেন বিখ্যাত সাংবাদিক, চলচ্চিত্রতাত্ত্বিক জর্জ স্যাডোল (GeorgesSadoul)। সাক্ষাৎকারটি ম্যাজিক লণ্ঠন-এর জন্য বাংলায় ভাষান্তর করেছেন প্রদীপ দাস  

 

জর্জ স্যাডোল : এম লুই লুমিয়ের, মূলত কোন্ বিষয়গুলো আপনাকে গতিশীল আলোকচিত্রের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিলো?

লুই লুমিয়ের : ১৮৯৪ সালের গ্রীষ্মকালে যখন আমি ও আমার ভাই অগাস্ত প্রথম কাজ শুরু করি, ততোদিনে  মেরি (Etienne Jules Marey), এডিসন ও ডিমেনির (Georges Demeny) গবেষণা একটা সম্ভাব্য ফলাফলের দিকে পৌঁছে গেছে। কিন্তু তখনো পর্দায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মানসম্মত কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। তাই এমন একটি পদ্ধতির চিন্তা করা হচ্ছিলো, যেনো চলচ্চিত্রে ছবির ফ্রেমগুলো ব্যবহার করে সমস্যার সমাধান করা যায়। এ লক্ষ্যে অগাস্ত একটি খাঁজকাটা সিলিন্ডার ব্যবহারের চিন্তা করেন। যদিও ওই একই রকম অন্য একটি বিশেষ যন্ত্রের প্রস্তাব করেন লিয়ন বুলি (Laeon boully)। কিন্তু তার এই প্রক্রিয়াটি ছিলো এলোমেলো। ফলে এটা ভালোভাবে কাজ করছিলো না, আর পরে অবশ্য কখনো করেওনি।

স্যাডোল : তাহলে অগাস্ত লুমিয়ের কি অন্য কোনো পদ্ধতির বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন?

লুই : না, অগাস্ত তো সিনেমাটোগ্রাফের প্রাযুক্তিক দিক থেকে তখন প্রায় আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছিলো। তাই আমি দ্রুত যন্ত্রটি ঠিকভাবে চালানোর একটি পদ্ধতি বের করে ফেলি। যদিও সিনেমাটোগ্রাফের স্বত্ব আমাদের দুজনের নামেই হয়েছিলো। কারণ, আমরা যেসব কাজ করেছি সেখানে সবসময় দুজন একই সঙ্গে স্বাক্ষর করতাম। ফলে স্বত্ব আবেদনের যে ফরম তাতেও একই সঙ্গে দুজন স্বাক্ষর করি। অবশ্য, দুজনে একসঙ্গে কাজ না করলেও সবসময় এটাই আমরা করতাম। মূলত, আমিই সিনেমাটোগ্রাফের মূল স্বত্বাধিকারী। সে (অগাস্ত) ছিলো তার দিক থেকে অন্য বিষয়গুলোর উদ্ভাবক; অবশ্য সেগুলোর স্বত্বও আমাদের দুজনের নামেই হয়েছে।

স্যাডোল : আপনি কোন্ পদ্ধতিতে কাজ করার প্রস্তাব করেছিলেন?

লুই : আমি মূলত কাজটি না করতে পেরে অস্বস্তিবোধ করছিলাম; একপর্যায়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। একদিন রাতে আমার ঘুম আসছিলো না, তখন হঠাৎ-ই বিষয়টি আমার মাথায় আসে। তারপর ক্যামেরাতে যন্ত্রটি এমনভাবে প্রতিস্থাপন করেছিলাম, যা খানিকটা সেলাই মেশিনের প্রেসার ফুটের (সেলাই মেশিনে কাপড়কে যার দ্বারা চাপ দিয়ে আটকে রেখে সেলাই করা হয়) মতো। প্রথমে আমি যন্ত্রের ওই অংশটিকে গোলাকার আকৃতিতে নিয়ে আসি, তখন বস্তুটি কিছুটা অদ্ভুত দেখাচ্ছিলো। আমি খুব দ্রুত একই ধরনের আরেকটি যন্ত্রাংশ দিয়ে এটি পরিবর্তন করে দিই, সেটি দেখতে ত্রিভুজ আকৃতির ছিলো।

স্যাডোল : শেষ পর্যন্ত তাহলে আপনার আবিষ্কৃত মূল তত্ত্বগুলোর ভিত্তিতেই পরীক্ষামূলকভাবে বিশেষ যন্ত্রটি নির্মাণ করেছিলেন?

লুই : আমাদের কারখানার প্রধান প্রকৌশলী এম মইসন (Moisson) সর্বপ্রথম এই যন্ত্রটি সাজান। তিনি মূলত আমাদের দেওয়া নকশা অনুযায়ীই এটি করেন। ফ্রান্সে আমাদের বানানো এই যন্ত্রটি তখন মূলত স্বচ্ছ সেলুলয়েড ফিল্ম ধরে রাখতে পারছিলো না। তাই আমি আবার আমাদের কারখানায় থাকা ফটোগ্রাফিক কাগজের ফ্রেমগুলো দিয়ে পরীক্ষা করতে থাকি। আমি সেগুলোকে আমার মতো করে কেটে ছোটো ছোটো ছিদ্র করি। আর আপনি (স্যাডোলকে লক্ষ্য করে) নিশ্চয় জানেন, আমার এই কাজটির প্রাথমিক ফলাফল ছিলো চমৎকার।

স্যাডোল : সত্যি বলতে কি, প্যারিসের Cinematheque Francaise আর্কাইভে (পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ চলচ্চিত্র আর্কাইভ) আপনার জমা দেওয়া সেই লম্বা ফ্রেমগুলো দেখে আমি অভিভূত হয়েছিলাম। এর ছবিগুলো তো যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন ছিলো!

লুই : আসলে ওই ফ্রেমগুলো ছিলো শুধুই পরীক্ষামূলক। এগুলো মাত্রাতিরিক্ত অস্বচ্ছ হওয়ায় পর্দায় নিক্ষেপ করা যাচ্ছিলো না। তা সত্ত্বেও আমি পরীক্ষাগারে এগুলোকে গতিশীল করেছিলাম। এজন্য আমি শক্তিশালী আলোর ব্যবহার করি, যেনো প্রতিফলিত দৃশ্যটি পর্দায় স্বচ্ছভাবে দেখতে পাওয়া যায়। আর এ থেকে আমি চমৎকার ফলাফলও পাই।

স্যাডোল : আধুনিক চলচ্চিত্রে যে মানের সেলুলয়েড ফিল্ম ব্যবহার করা হয়, সেই মানের ফিল্ম ব্যবহারের আগে আপনাকে কি দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়েছিলো?

লুই : না, হঠাৎ করেই আমি সেলুলয়েড ফিল্ম ব্যবহার শুরু করে দিই। ফ্রান্সে সেসময় নমনীয়, স্বচ্ছ সেলুলয়েডের ব্যবহার করতে পেরে আমার খুবই ভালো লেগেছিলো। তখনো ফ্রান্স কিংবা ব্রিটেনের অন্য ফার্মগুলোর কেউই এ রকম স্বচ্ছ সেলুলয়েড ফিল্ম তৈরি করতে পারেনি। তাই আমি যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের একজন ব্যবস্থাপককে পাঠাই। তিনি দ্য নিউইয়র্ক সেলুলয়েড কোম্পানির কাছ থেকে নন-সেন্সিটাইজড সেলুলয়েড শিট (সহজে আলো গ্রহণ করতে পারে না এমন) কিনে লিওঁ-তে (শহর) আমাদের কাছে নিয়ে আসেন। এরপর সেগুলো আমাদের বানানো সিনেমাটোগ্রাফ যন্ত্রে ব্যবহার করার জন্য সেলাই মেশিনের নকশার ওপর ভিত্তি করে কেটে ছিদ্র করি। আর সবশেষে এম মইসন পুরো যন্ত্রটি ব্যবহার উপযোগী করে তোলেন।

স্যাডোল : ঠিক কবে আপনি প্রথম সেলুলয়েডে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন?

লুই : ১৮৯৪ সালের গ্রীষ্মের প্রায় শেষের দিকে আমি আমার প্রথম চলচ্চিত্র ওয়ার্কারস লিভিং দ্য লুমিয়ের ফ্যাক্টরি নির্মাণ করি। এখানে আপনি লক্ষ করবেন, পুরুষরা স্ট্র হ্যাটস আর নারীরা গরমের কাপড় পরেছিলো। এই দৃশ্যটি ধারণ করার জন্য আমাদের উজ্জ্বল আলোর প্রয়োজন ছিলো, কিন্তু আমাদের ক্যামেরার লেন্স অতোটা শক্তিশালী ছিলো না। শীত কিংবা শরতের শেষের দিকে এ রকম একটি দৃশ্য ধারণ করা আমাদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হতো না।

প্যারিসের রুই ডি বেন্ (Rue De Bennes)-এ অবস্থিত Societe d’Encouragement pour l’Industrie Nationale-এর (ফ্রান্সের এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত শিল্প-কারখানা ও প্রযুক্তির বিভিন্ন দিক উদ্ভাবনে কাজ করে থাকে। ১৮০১ সালে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়) সামনে জনসম্মুখে চলচ্চিত্রটির প্রথম প্রদর্শনী হয়। দিনটি ছিলো ১৮৯৫ সালের ২২ মার্চ। প্রদর্শনী শেষে কয়েকজনের বক্তৃতার পর আমি শেষ পর্যায়ে ফটোগ্রাফিক ইমেজের গঠন প্রক্রিয়াটি দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করি। অবশ্য এই গঠন দেখানোর বিষয়টিও বেশ জটিল ছিলো, যাহোক ওইদিকে আমি আর যেতে চাচ্ছি না। 

স্যাডোল : আচ্ছা, এরই মধ্যে আপনার আবিষ্কৃত বিশেষ যন্ত্রপাতিগুলোকে কি সিনেমাটোগ্রাফ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো?

লুই : তখন এসব নিয়ে আমি ভাবিনি। কারণ এর নামকরণ আমরা আগেই করে ফেলেছিলাম। ১৮৯৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আমরা এর স্বত্ব নিয়ে নিই। তাই এর নাম নিয়ে আলাদাভাবে আমাদের কিছু ভাবতে হয়নি। তবে আমরা আমাদের স্বত্বে উল্লেখ করেছিলামএটি ক্রনোফটোগ্রাফিক প্রিন্ট-এর (ছবি ধারণ, রেকর্ড ও প্রদর্শন করার যন্ত্র) মতো একটি বিশেষ যন্ত্র। আমরা এর প্রায় কয়েক সপ্তাহ পরে যন্ত্রটির নাম দিই সিনেমাটোগ্রাফ।

আমার বাবা আঁতোয়া লুমিয়ের কিন্তু সিনেমাটোগ্রাফ নামটি মেনে নিতে পারেননি। তিনি তার বন্ধু লেকহিয়ার-এর (Lechere) প্ররোচনায় যন্ত্রটির নাম ডমিটর (Domitor) রাখতে বলেছিলেন।

স্যাডোল : ডমিটর বলতে কী বোঝায়?

লুই : আমি ঠিক জানি না ডমিটর মানে কী; তবে লেকহিয়ার মনে হয় একাধিক শব্দের ধ্বনি ও অর্থ সংযুক্ত করে এই শব্দটি তৈরি করেছিলেন। শব্দটির উৎপত্তি সম্ভবত ক্রিয়াবাচক শব্দ ডমিনেট থেকে; পরে ডমিনেটর থেকে ডমিটর। কিন্তু অগাস্ত ও আমার কাছে কখনোই এই নামটি ভালো লাগেনি, আমরা কখনোই এটি ব্যবহার করিনি।

স্যাডোল : সিনেমাটোগ্রাফের পূর্ণতা আনার ক্ষেত্রে আপনাকে কি এমন কোনো প্রাযুক্তিক সমস্যায় পড়তে হয়েছিলো, যার কোনো সহজ সমাধান ছিলো না?

লুই : আসলে ফিল্ম নিয়েই আমাদের সমস্যা যেনো মিটছিলো না। যদিও তখন সেলুলয়েড চলে এসেছে, কিন্তু আমরা এর মান, গুণাগুণ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতাম না। নিরুপায় আমি শেষ পর্যন্ত ফিল্ম নিয়ে পদ্ধতিগতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দিই। প্রথমে আমি বিভিন্ন ডায়ামিটারের উপযোগী করে সুঁচ দিয়ে ফিল্মফ্রেমগুলো ছিদ্র করি। তারপর আমি সেগুলোকে এমনভাবে আটকাই যেনো ঘোরার সময় কোনো সমস্যা না করে। ফিল্মের ছিদ্র ও পিনের আকার সমান হওয়ায় কিছু সমস্যা হচ্ছিলো। ফলে আমি ছিদ্রটা একটু বড়ো করি, যাতে কোনো সমস্যা ছাড়াই পিন এটার ভিতর দিয়ে সহজে যাতায়াত করতে পারে। আর এভাবেই আমি অনেকখানি সফল হই।

স্যাডোল : আপনার কারখানাতেই কি সিনেমাটোগ্রাফ যন্ত্রের বাণিজ্যিক উৎপাদন করা হতো?

লুই : না, এই যন্ত্রের কোনো অংশই আমাদের কারখানায় তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তাই আমরা সিনেমাটোগ্রাফ যন্ত্রটি উৎপাদনে যেতে পারিনি। আমি ১৮৯৫ সালের শুরুর দিকে প্যারিসে যে বক্তৃতাটি দিই, সেটা শুনে জুলস কার্পেন্টিয়ার (Carpentier) নামে এক প্রকৌশলী আমার ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে। আমাদের এ বন্ধুত্ব জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অটুট ছিলো। যাহোক, কার্পেন্টিয়ার তার কারখানায় আমাদের এই যন্ত্রটি উৎপাদনের আগ্রহ প্রকাশ করলে আমি রাজি হয়ে যাই। তিনি ১৮৯৬ সালের শুরুর দিকে আমাদের কাছে প্রথম ১০টি সিনেমাটোগ্রাফ যন্ত্র সরবরাহ করেন। এর আগে অবশ্য লিওঁ-তে তৈরি করা এই একটি যন্ত্র নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিলো।

স্যাডোল : তার মানে আপনি শুধু একটি যন্ত্র দিয়েই ১৮৯৫ সাল থেকে সব ছবি তুলেছেন এবং সেগুলো প্রদর্শন করেছেন। এ সময়ে সিনেমাটোগ্রাফে ছবি তোলার মূল অপারেটর কি আপনি নিজেই ছিলেন?   

লুই : হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। ১৮৯৫ সালে যেসব চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হয়েছিলো যেমন : জুনে লিওঁ-র ফটোগ্রাফিক কংগ্রেসে, জুলাইয়ে প্যারিসের ঞযব জবাঁব The Revue Generale des Sciences-G এবং ২৮ ডিসেম্বর প্যারিসের গ্র্যান্ড ক্যাফের নিচতলায়সবগুলোর অপারেটর আমি নিজেই ছিলাম। তবে লা সিয়োতা (La Ciotat) প্রদেশে ছুটি কাটাতে গিয়ে সেখানে আমার বদলে অগাস্ত Les bruleuses d'Herbes চলচ্চিত্রটির প্রদর্শনীর অপারেটরের কাজ করেছিলো, এই একটাই শুধু ব্যতিক্রম।

ও আর একটা বিষয় এখানে বলা দরকার, আমি শুধু চলচ্চিত্রগুলো নির্মাণই করিনি, গ্র্যান্ড ক্যাফের প্রদর্শনীতে যে ফিল্ম ফ্রেমগুলো ব্যবহার করা হয়েছিলো, সেগুলো আমি নিজেই পরিস্ফুটন (Developed) করি। এজন্য আমি অ্যানামেলের প্রলেপ দেওয়া লোহার বালতিতে রাখা পরিস্ফুটনের সামগ্রীতে প্রথমে ফিল্ম ডুবাই, তারপর ফিল্মের ইমেজ স্থায়ী করার যে দ্রব্য (Fixative) সেটাতে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখি। এরপর পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলি। অন্যান্য ফিল্মগুলোও একইভাবে প্রিন্ট করা হয়েছিলো। এসব কাজের জন্য প্রয়োজনীয় আলোর উৎস হিসেবে আমি সূর্যের আলো পড়ে এমন একটি সাদা দেয়াল ব্যবহার করেছিলাম।

স্যাডোল : এম লুমিয়ের, আপনার পার্টি কার্ড (Partie d’Ecart) চলচ্চিত্রটি নিয়ে কিছু বলুন?

লুই : ওখানে দেখবেন আমার বাবা আঁতোয়া লুমিয়ের সিগারেট ধরাচ্ছিলেন, আর কার্ড বাঁটছিলেন তার বন্ধু ট্রিওয়ে (Trewey)। ট্রিওয়ে পেশায় ছিলেন মূলত একজন জাদুকর, তিনি লন্ডনে আমাদের চলচ্চিত্রের প্রদর্শনীরও ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই সূত্রে পার্টি কার্ড ছাড়াও আমাদের আরো কয়েকটি চলচ্চিত্রে ট্রিওয়ে অভিনয় করেন। Assiettes Tournants তার অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে অন্যতম। আর যে লোকটি গ্লাসে মদ ঢালছিলেন তিনি আমার শ্বশুর। আমার শ্বশুরবাড়ি লিওঁর উইঙ্কলার-এ, তিনি (শ্বশুর) আসলে মদের ব্যবসা করতেন। আর এদের পাশে দাঁড়িয়েছিলো একজন ভৃত্য। পরে অবশ্য ওই লোকটি স্থায়ীভাবে আমাদের বাড়িতেই কাজ করেছিলো। দক্ষিণ ফ্রান্সের বংশোদ্ভূত ওই লোকটির জন্ম কনফারন শহরে। ওই লোকটি উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে মজার মজার কৌতুক বলে সবাইকে আনন্দ দিতে পারতো।

এছাড়া ১৮৯৫ সালে লা সিয়োতা স্টেশনে (La Ciotat Station) ট্রেন অ্যারাইভাল অব দ্য স্টেশন (The Arrival of a Train at La Ciotat Station) চলচ্চিত্রটির দৃশ্যায়ন করি। সেখানে নিশ্চয় আপনার মনে আছে, প্লাটফর্মে একটু দূরে দুই পাশে দুই হাত ধরে একটা বাচ্চা হাঁটা-চলা করছিলো। ওই ছোটো বাচ্চাটি আমার বড়ো মেয়ে। আর স্কটিশ পোশাকে আরেক যে নারীকে দেখা যায় তিনি মিসেস আঁতোয়া মানে আমার মা।

স্যাডোল : এবার আপনার বিখ্যাত চলচ্চিত্র দ্য ওয়াটারার ওয়াটার্ড নিয়ে আমাদের কিছু বলবেন?

লুই : যদিও আমার স্মরণশক্তি অতোটা ভালো নয়, কিন্তু যতোদূর মনে পড়ে চলচ্চিত্রের হাস্যরসাত্মক এই ধারণাটা আমরা পেয়েছিলাম ছোটো ভাই এডুয়ার্ড-এর (Edouard) কাছ থেকে। ও বৈমানিক ছিলো, আমাদের দুর্ভাগ্য ওকে আমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪১৯১৮) হারাই। যাক সে কথা, এডুয়ার্ডকে দিয়ে অবশ্য আমরা শিশুচরিত্রে অভিনয় করাইনি। যদিও বাগানে নল দিয়ে পানি দেওয়ার সময় এডুয়ার্ড-ই এই কাজটি নিয়মিত করতো; কিন্তু চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সে খুব ছোটো ছিলো।

তাই আমাদের কারখানা থেকে দুভাল নামে নতুন একটা ছেলেকে অভিনয় করার জন্য আনা হয়। দুভাল অবশ্য পরে আমাদের কারাখানায় দীর্ঘ ৪২ বছর প্রধান প্যাকার (যে ব্যক্তি মোড়ক বাঁধে) হিসেবে কাজ করেন। সম্প্রতি তিনি মারা গেছেন। আর নল দিয়ে গাছে পানি দেওয়া লোকটি আমাদের বাগানেরই মালী এম ক্লার্ক (Clerc)। ক্লার্ক অবশ্য এখনো বেঁচে আছেন। তিনিও দীর্ঘ ৪০ বছর আমাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। অবসর নেওয়ার পর ক্লার্ক এখন ভ্যালেন্স (Valence) শহরের কাছে থাকেন।

স্যাডোল : আচ্ছা এবার বলুন, ১৮৯৫ সালে আপনি মোট কতোগুলো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন? 

লুই : যদিও হিসাব রাখার ক্ষেত্রে আমার স্মৃতি অতোটা নির্ভরযোগ্য নয়। তার পরও যতোদূর মনে পড়ে ৫০টির মতো চলচ্চিত্র আমরা নির্মাণ করেছিলাম। চলচ্চিত্রের সবগুলোই ছিলো ১৭ মিটার দৈর্ঘ্যরে আর ব্যাপ্তি ছিলো গড়ে এক মিনিট। ১৭ মিটার দৈর্ঘ্যটা একটু অস্বাভাবিক মনে হতে পারে, কিন্তু উপায় ছিলো না। কারণ তখন নেগেটিভ রাখার যে স্পুলবক্স ছিলো সেটাতে ১৭ মিটারের বেশি ফিল্ম পেঁচিয়ে রাখা যেতো না।

স্যাডোল : ১৮৯৫ সালের পরে আপনি আর কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি?

লুই : করেছি, তবে খুবই কম। এ সময় আমি মূলত প্রমিও (Promio), ম্যাচগিইস (Mesguich), ডাবলিয়ার (Doublier), প্যারিগটসহ (Perrigot) আমাদের যারা প্রশিক্ষিত অপারেটর ছিলো, তাদের হাতে সবকিছু ছেড়ে দিই। কয়েক বছরের মধ্যে এরা সারাবিশ্ব থেকে নির্মিত ১২শর বেশি চলচ্চিত্র আমাদের তালিকায় যুক্ত করে। 

স্যাডোল : কবে থেকে সিনেমাটোগ্রাফের ওপর আপনার আগ্রহ কমতে শুরু করেছিলো?

লুই : আমার সর্বশেষ কাজের কথা বলতে গেলে ১৯৩৫ সালে ফিরে যেতে হবে। সেসময় আমি স্টেরিয়োস্কোপিক সিনেমা(Stereoscopic Cinema) নামে নতুন একধরনের প্রযুক্তিতে সফলতা পাই। তারপর এই প্রযুক্তি দিয়ে প্যারিস, লিওঁ, মারসেইলেস ও নিসে শহরেও চলচ্চিত্র প্রদর্শন করি। এছাড়া আমি বিজ্ঞানভিত্তিক কিছু গবেষণায় নির্দেশনার কাজ করি। আমি কিন্তু কখনোই সরাসরি, যেটাকে চলচ্চিত্র প্রোডাকশন বলে তার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। আমি কখনো মনে করিনি, আমি আধুনিক স্টুডিওর উপযুক্ত। এছাড়া কিছু সময় আমি কাজ করতে অসমর্থও ছিলাম এবং বেশিরভাগ সময় ব্যান্ডল-এ ছিলাম।

 

দায়স্বীকার : লুই লুমিয়ের-এর এই সাক্ষাৎকারটি প্রবোধ মৈত্র সম্পাদিত ১০০ 100 Years of Cinema (১৯৯৫) গ্রন্থের ÔThe last interview of Louis LumiereÕ থেকে নেওয়া হয়েছে। গ্রন্থটি নন্দন, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত।

 

অনুবাদক : প্রদীপ দাস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

pradipru03@gmail.com

 

বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৪ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের ষষ্ঠ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন