রাজীব আহসান
প্রকাশিত ১০ জুন ২০২৩ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
বুদ্ধদেব-এর সঙ্গে স্বপ্ন ও জাদুবাস্তবতাময় এক মাতাল আড্ডার স্মৃতি
রাজীব আহসান
এক ঘামে ভেজা তপ্ত দুপুরে চিৎ হয়ে শুয়ে কমলকুমার মজুমদার-এর দুর্বোধ্য উপন্যাস ‘সুহাসিনীর পমেটম’ পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে খানিকটা ঝিমিয়ে পড়েছিলাম। এর-ই মধ্যে বিদ্যুৎ চলে যায়। থেমে যায় ফ্যানের অবিরাম ঘূর্ণন। নাকের ডগায় জমতে থাকে অস্বস্তিকর স্বেদবিন্দু। এক ভয়ঙ্কর নৈঃশব্দের ভেতর আমি তলিয়ে যেতে থাকি। হঠাৎ তা ভেদ করে দানবের মতো বেজে ওঠে সেলফোনটি। স্ক্রিন-এ তাকিয়ে দেখি অপরিচিত এক নম্বর। কথা বলার আগ্রহ না থাকায় ফোনটা আর ধরা হয় না। কিছুক্ষণ পর একই নম্বর থেকে আবারও ফোন আসে। চরম বিরক্তি নিয়ে এবার রিসিভ করি। অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে আসে গৌতম ঘোষের দরাজ কণ্ঠ-‘রাজীব, আমি ঢাকায়, ধানমন্ডিতে। ফ্রি থাকলে এক্ষুনি চলে এসো।’
দুপুরের আলস্যকে প্রত্যাখ্যান করে আধা ঘণ্টার মধ্যে আমি পৌঁছে যাই ধানমন্ডির সেই রেস্টহাউজ-এ। দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে গৌতম দা বলে ওঠেন-‘খোলা আছে, ভেতরে আসো।’ ভেতরে ঢুকে সোফায় বসা গৌতম দা’র সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় হয়। অতঃপর খাটে শুয়ে বই পাঠরত বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে গৌতম দা বললেন-‘বুদ্ধ, এই হলো রাজীব। ইয়াং ফিল্মমেকার।’ বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পাঠরত বই কিছুটা ফাঁক করে মৃদু হাসিতে সম্ভাষণ বিনিময় করে পুনরায় পাঠে মনোনিবেশ করলেন। পাঠের ব্যাঘাত ঘটায় তিনি কিছুটা বিরক্ত, যার ছাপ তার মুখাবয়বে স্পষ্ট অনুভূত হচ্ছিলো।
গৌতম দা আমার থেকে ঢাকার লোকজনের খবরাখবর নিচ্ছেন। জানার চেষ্টা করছেন এখানকার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সর্বশেষ অবস্থা। এর-ই মধ্যে চা এলো। চা-তে চুমুক দিতেই আবার দরজায় নক। আমি দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকলেন অভিনয়শিল্পী রোজি সিদ্দিকী। যিনি গৌতম ঘোষের পদ্মা নদীর মাঝিতে গণেশের বউ-এর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন তার মেয়েকেও। রোজি আপা কিছুটা এক্সসাইটেড হয়ে গৌতম দা’র সঙ্গে পুরনো দিনের নানা স্মৃতিচারণ করে চলছেন, তো চলছেন। এদিকে বই পাঠে ব্যাঘাত ঘটায় বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত চরম বিরক্ত! তা প্রকাশের জন্য তিনি মাঝে মাঝে আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত করে পুনরায় পাঠে মনোনিবেশের চেষ্টা করছেন। বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হলেও নির্বাক শ্রোতা হওয়ায় আমার কিছুই করার ছিলো না। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক আলাপচারিতার পর রোজি আপা যখন চলে যাবেন, তখন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। এরপর খুব কোমল স্বরে বললেন, ‘আপনি খুব গুণী মানুষ। আমি আপনার এবং আপনার সিনেমার ভীষণ ভক্ত।’ মুহূর্তেই বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সব বিরক্তি উধাও হয়ে গেলো। চোখে-মুখে ফিরে এলো চনমনে ভাব! মৃদু হেসে হেসে রোজি আপার সঙ্গে কথা বললেন। একটা পড়ন্ত বিকেল সঙ্গে করে রোজি আপা বিদায় নিলেন।
সন্ধ্যা নেমে এলো। ল্যাম্পপোস্ট-এর ম্রিয়মাণ ফ্যাকাশে আলো আছড়ে পড়লো ধানমন্ডি লেক-এর দূষিত জলে। গৌতম দা ও আমার আড্ডা পুনরায় শুরু হলো এবং বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পুনরায় বই পড়তে শুরু করলেন। আড্ডা সিরিয়াস হতে শুরু করলো আস্তে আস্তে। শুরুটা হলো ফরাসি নিউ ওয়েভ দিয়ে। ত্রুফো-গদার-রোমার-শ্যাব্রল হয়ে আড্ডা চলে গেলো ফরাসি বিপ্লবে। ফরাসি বিপ্লবের নানা অলিগলি পেরিয়ে ফরাসি কবিতায়। লুই আরাঁগ, গীয়াম এপোলিনেয়ার, জ্যঁ ককতো, পল এলুয়ার, আঁরি মিশো, সাঁ জন পার্স, রেনে শার ও শার্ল বোদলেয়ার-এর কবিতার সুঘ্রাণে জমজমাট হয়ে ওঠে আড্ডা। ফরাসি কবিতার মাতাল সৌরভে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পাঠরত বইটি বিছানায় রেখে আমাদের আড্ডায় যোগ দিলেন। আরো ঘন হয়ে এলো আড্ডা। একপর্যায়ে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত হয়ে ওঠলেন বুদ্ধদেব দা। ফরাসি দেশ থেকে আড্ডা চলে এলো ভারতবর্ষে। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনকে নিয়ে কেটে গেলো অনেকটা সময়। এবার পরবর্তী প্রজন্মের সিনেমা নিয়ে কথা উঠতেই আমি বুদ্ধদেব দাকে বললাম-আপনার সিনেমাগুলো আমার খুবই প্রিয়। আমি বারবার দেখি। একে একে বলতে থাকি-নিম অন্নপূর্ণা, গৃহযুদ্ধ, ফেরা, বাঘ বাহাদুর, তাহাদের কথা, চরাচর, লাল দরজা, উত্তরা, মন্দ মেয়ের উপাখ্যান, স্বপ্নের দিন, আমি, ইয়াছিন আর আমার মধুবালা, কালপুরুষ ও জানালার কথকতা এবং এই সিনেমাগুলোর বহুস্তরীয় শিল্পভাষ্য নিয়ে। আমি তার এডাপটেশন-এর ভূয়শী প্রশংসা করি। তিনি কাজ করেছেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র, কমলকুমার মজুমদার, প্রফুল্ল রায়, সমরেশ বসু প্রমুখ খ্যাতিমান কথাশিল্পীর গল্প নিয়ে। কিন্তু যেভাবে তিনি মূল গল্পের সঙ্গে স্বপ্ন ও জাদু মিশিয়ে এক অপূর্ব ইমেজের খেলায় মেতে ওঠেন-তা হয়ে ওঠে চলচ্চিত্রের অনন্য এক বুদ্ধদেবীয় ভাষা। যা তাকে পৃথক করেছে পৃথিবীর আর সব চলচ্চিত্রকারদের থেকে।
আমার এইসব দীর্ঘ বয়ান বুদ্ধদেব দা ও গৌতম দা মগ্ন হয়ে শুনতে থাকেন। বুদ্ধদেব দার দুটি চলচ্চিত্র বিষয়ক বই-‘স্বপ্ন, সময় ও সিনেমা’ এবং ‘কীভাবে ছবি করি, কীভাবে ছবি হয়’। এই দুটি বই আমাকে যে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে সেকথাও বলি। সবশেষে তার ‘যদি’ কবিতাটি স্মৃতি থেকে আউড়ে দিই-
আমি যদি ঘুমের ভেতর তোমার নাক ছুঁই
তাহলে তোমার কিচ্ছু বলার নেই।
ঘুমের ভেতর আমি যদি একলা হাতের
ছোট্ট আংটি হই
তাহলে তোমার কিচ্ছু বলার নেই।
গড়িয়াহাটের মোড়ে
কত্তো মেয়ে ঘোরে
কারোর চোখে চোখ রেখেছি, আমি?
ঘুমের ভেতর সত্যি তোমার পাশে শুই,
তবুও তোমার কিচ্ছু বলার নেই।
কবিতাটি আমি খুব আবেগ দিয়ে পড়ছিলাম। শেষ হওয়া মাত্র গৌতম দা হাততালি দিলেন। বুদ্ধদেব দা আর স্থির থাকতে পারলেন না। সমস্ত গাম্ভীর্য ভেঙ্গে আলমিরার ভেতর থেকে একটা ব্ল্যাক লেভেল হুইস্কির বোতল বের করে মৃদুস্বরে বললেন-‘খাও তো?’ আমি মিনমিন করে বললাম-‘মাঝে মধ্যে।’ গৌতম দা ভারী কণ্ঠে বললেন, ‘আরে খায়...খায়।’ অতঃপর রেস্টহাউজের একটা ছেলে বরফের কিউব ও ঠাণ্ডা পানির বোতল দিয়ে গেলো। বুদ্ধদেব দা তিনটা গ্লাসে হুইস্কি ঢাললেন। দু’টো করে বরফের কিউব ও অল্প পরিমাণ জল ঢেলে দিলেন। তিনটি গ্লাস ঠুকাঠুকির পর আমরা একসঙ্গে বলে উঠলাম-চিয়ার্স।
কিছু পরিমাণ হুইস্কি পেটে চালান হতেই আড্ডা জমে উঠলো। বুদ্ধদেব দা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন-কোন ধরনের ছবি আমার প্রিয়? দ্বিধাহীনভাবে বললাম-‘আমি ইউরোপিয়ান আর্ট হাউজের ভক্ত। তবে দর্শক হিসেবে সর্বগ্রাসী।’ আমাদের জলজ আড্ডা আরো গাঢ় হতে শুরু করলে বাগড়া দিতে চলে এলেন এক ভদ্রলোক। তিনি বুদ্ধদেব দা ও গৌতম দা-কে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ করে এনেছেন এক অনুষ্ঠানে; যা পরদিন বিকেল পাঁচটায় পাবলিক লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত হবে। সেই ভদ্রলোক কেনো জানি চরম বিরক্তি নিয়ে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। গৌতম দা ভদ্রলোকটির সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এবার ভদ্রলোক মহাশয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাকে নানারকম প্রশ্ন করছেন। শুনেছি, বিয়ের পাত্র-পাত্রীকে এই ধরনের প্রশ্ন করা হয়। বাবা কী করে, মা কী করে? ভাই-বোন কতোজন? পড়ালেখা কতোদূর? শুধু কি সিনেমা করা হয়, আর কিছু নয়? ইনকাম কতো? কী করে জীবন চলছে? ভদ্রলোকের এইসব প্রশ্নে বুদ্ধদেব দা ও গৌতম দা-ও খানিক বিরক্ত মনে হচ্ছিলো। গৌতম দা প্রসঙ্গ পাল্টে আগামীকালের অনুষ্ঠান নিয়ে তার সঙ্গে কথা বললেন। ওই কথা শেষ হলে ভদ্রলোক পুনরায় আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন-আমার বয়স কতো? এইবার আমি চরম বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিই-‘শূন্য’। ভদ্রলোক হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। একপর্যায়ে বুদ্ধদেব দা লোকটিকে বললেন-‘এবার তাহলে আপনি আসুন। কাল চারটার গাড়ি পাঠিয়ে দিবেন।’ এবার ওই ভদ্রলোক আমাকে বললেন-‘আপনি যাবেন না।’ বুদ্ধদেব দা কিছুটা রাগত স্বরে বললেন-‘তিনি যাবেন না। আপনি আসুন।’ ভদ্রলোক হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন।
সবমিলিয়ে আমার এক ধরনের অস্বস্তি অনুভূত হচ্ছিলো। আমাদের বঙ্গীয় সংস্কৃতিতে সিনিয়র জুনিয়র-এর যে হাস্যকর প্রথা, লোকটি তা থেকে বেরোতে পারেননি। তিনি মনে করেছেন, গৌতম ঘোষ ও বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে তাদের হাঁটুর বয়সি এই বাচ্চা ছেলে হুইস্কি খাচ্ছে-এটা তো চরম বেয়াদবি। যাই হোক, লোকটি চলে যাওয়ার পর আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। এরই মধ্যে রেস্ট হাউজ থেকে রাতের খাবার দিয়ে যায়। আমরা রুমালি রুটি, সবজি, ডাল আর মুরগির মাংস দিয়ে খাই। আহারান্তে গৌতম দা আয়েশ করে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে প্যাকেট দেখিয়ে আমাকে বললেন-‘তাকিয়ে দেখছো কী? খেলে খাও?’ আমি বললাম-‘দাদা, আমি ভালো ছেলে। ধুমপান করিনা, শুধু জল পান করি।’ হো হো করে হেসে উঠলেন বুদ্ধদেব দা।
শুরু হলো দ্বিতীয় দফার হুইস্কিময় আড্ডা। বুদ্ধদেব দা ফিরে গেলেন তার শৈশবের বর্ণিল দিনগুলোতে। যে শৈশবে মিশে ছিলো স্বপ্ন আর ম্যাজিক। যার প্রতিফলন দেখতে পাই তার প্রায় প্রতিটি সিনেমায়। তার বিখ্যাত লাল দরজায় দন্ত চিকিৎসক যখন শৈশবে ফিরে গিয়ে বলেন-‘ছোটি মোটি পিঁপড়া বোটি, লাল দরজা খোল দে।’ বুদ্ধদেব দা জানালেন, এটা তারই শৈশব। কথা হলো মন্দ মেয়ের উপাখ্যান-এর সেই কিশোরী মেয়েটিকে নিয়ে। সে যেই দিন পতিতালয়ের নরককুণ্ড থেকে মুক্তি পায়, সেই দিনই চাঁদে পা রাখে মানুষ। কী অদ্ভুত মিশেল দুটো ঘটনার। তারপর কথা এগোতে থাকে উত্তরা, স্বপ্নের দিন, জানালা, চরাচরসহ অন্যান্য সিনেমা নিয়ে।
এবার বুদ্ধদেব দা তার নির্মাণাধীন সিনেমা টোপ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। এটি তিনি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘টোপ’ গল্প অবলম্বনে নির্মাণ করছেন। আমি তাকে আবারও গল্পের এডাপটেশন বিষয়ক নানারকম প্রশ্ন করতে থাকলাম। দীর্ঘ আলাপচারিতায় বুঝে নিই-তিনি কী করে বাস্তবের সঙ্গে স্বপ্ন ও জাদুবাস্তবতার মিশ্রণ ঘটান। তার ছবি কী করে হয়ে ওঠে নতুন কিছু, ভিন্ন কিছু, সবার থেকে আলাদা এবং একদম বুদ্ধদেবীয়। এবার আমি তার সিনেমায় ইমেজের প্রসঙ্গ উত্থাপন করি। তিনি বলে চলেন-কীভাবে তার ভেতর ইমেজ খেলা করে। কীভাবে ইমেজের পর ইমেজ তিনি মগজে বয়ে বেড়ান। কোনোটি সিনেমায় দেখাতে পারেন, কোনোটি আজীবনের জন্য শুধু মস্তিষ্কেই প্রোথিত হয়ে থাকে।
রাতের শেষ প্রহর। শেষ হয়ে যায় হুইস্কির বোতল। একটা হাহাকারময় নিস্তব্ধতা নেমে আসে লেক ছুঁয়ে থাকা ধানমন্ডির এই রেস্ট হাউজটিতে। গৌতম দার অনুরোধে বুদ্ধদেব দা নিজের লেখা তিনটি কবিতা পরপর পাঠ করেন। অতঃপর গৌতম দা আমাকে অনুরোধ করেন একটা গান গাওয়ার। আমি সাহস করে [হুইস্কি খাওয়ার ফলে] গেয়ে উঠি-
Somewhere over the rainbow way up high
There’s a land that I heard of once in a lullaby
Somewhere over the rainbow skies are blue
And the dreams that you dare to dream really do
Come true
Somewhere over the rainbow bluebirds fly
Birds fly over the rainbow
Why them, oh, why can’t I?
If happy little bluebirds fly
Beyond the rainbow
Why, oh, why can’t I?
গান শেষ হয়। বেসুরো গলায় তালহীনভাবে গাওয়ার ফলে আমাকে দ্বিতীয় গানের অনুরোধ না করে গৌতম দা দরাজ কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন-
Country roads, take me home
To the place I belong
west virginia, mountain mama
Take me home, Country roads...
এই গান শেষ হলে আমাদের অনুরোধে গৌতম দা একের পর এক গাইতেই থাকেন। ফজরের আজানের ধ্বনিতে আমরা বুঝতে সক্ষম হই ভোর হয়েছে। আমাদের দীর্ঘ আড্ডা শেষ হয়। গৌতম দা ও বুদ্ধদেব দা’র নিকট থেকে বিদায় নিয়ে রেস্ট হাউজ ত্যাগ করি।
ধানমন্ডি লেকের পাড় ঘেঁষে রিকশায় চড়ে বাসায় ফিরছি। ভোরের হিম হাওয়ার ঝাপটা শরীরে লাগছে। হঠাৎ মনে হলো, রিকশায় আমার ডানপাশে একজন নারী বসে রয়েছে। শরতের ভোরের বাতাসের দোলায় তার চুলগুলো উড়ছে এবং মাঝে মাঝে আছড়ে পড়ছে আমার নাকে-মুখে। এক মায়াবী সুঘ্রাণ ভেসে আসছে সেই কেশগুচ্ছ থেকে। কে এই নারী? সে কি আমার কিশোরবেলার সেই মেয়েটি, যাকে দূর হতে বোকা বোকা চাহনিতে শুধু দেখতাম। নাকি যৌবনে দেখা মায়াভরা চাহনি আর টোল পড়া অপূর্ব হাসির পিয়ানো বাজাতে থাকা মেয়েটি। একি স্বপ্ন! একি ম্যাজিক! নাকি বুদ্ধদেবীয় জলজ আড্ডার ঘোর!
রিকশা থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাই বাসার ছাদে। রেলিং-এ হাত দিয়ে দাঁড়াই। টবে লাগানো বেলী ফুলের ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে ছাদময়। আমি বিস্তৃত ভোরের আকাশের দিকে অপার বিস্ময়ে চেয়ে থাকি। আমার চারপাশে উড়ছে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চরাচর সিনেমার লখিন্দর-এর না ধরা অসংখ্য পাখি। উড়তে থাকা একটা নীল রঙের পাখি এসে আমার বাম কাঁধে বসে। পাখিটি মিষ্টি স্বরে আমাকে বলে-‘উড়বে?’
প্রিয় বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, আপনার মৃত্যুকে আমি অস্বীকার করি।
লেখক : রাজীব আহসান, চলচ্চিত্রনির্মাতা।
razibaahsan@gmail.com
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন