আশিক মাহমুদ
প্রকাশিত ১৪ মে ২০২৪ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
মৃণাল সেন, সমকালীন বোধের বাতিঘর
আশিক মাহমুদ
ভারতীয় প্যারালাল চলচ্চিত্রের তিন দিকপাল নির্মাতাদের একজন মৃণাল সেন। সত্যজিৎ ও ঋত্বিকের সমসাময়িক এই অত্যর চলচ্চিত্রনির্মাতা তার ব্যতিক্রমধর্মী কাজ এবং বলিষ্ঠ রাজনৈতিক বক্তব্যের ভেতর দিয়ে আজও ভারত তথা বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতার স্থানে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন। ঋত্বিক কিংবা সত্যজিতের মতো তিনিও তার অনুপম সৃজনশীলতায় ভারতীয় চলচ্চিত্রকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের দরবারে যা তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এবং যার ঐতিহাসিক মূল্যও অনস্বীকার্য।
১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু মৃণাল সেনের। সেই থেকে মৃত্যু অবধি তার কাজের পরিসীমা ব্যাপক, বিস্তৃত এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। জীবদ্দশায় মোট ২৮টি কাহিনিচিত্র, চারটি তথ্যচিত্র, বেশ কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং টিভি সিরিয়াল নির্মাণ করেন তিনি। লেখালেখিতেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। চলচ্চিত্রবিষয়ক তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২২টি, চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে বাংলায় লেখা প্রথম গ্রন্থটির রচয়িতাও তিনি। তার এই বিশাল সৃষ্টি সম্ভার কিংবা একজন মৃণাল সেন হয়ে ওঠার পথটা কিন্তু মোটেও মসৃণ ছিলো না। শিল্প এবং চলচ্চিত্রের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা, নির্মোহ জীবনদর্শন তথা সময় ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা তাকে পৌঁছে দিয়েছিলো আজকের অবস্থানে। তার আপসহীন পথচলার সেই গল্পগুলো আজকের প্রজন্মের জন্য তাই হতে পারে অনুপ্রেরণার বাতিঘর।
দুই.
বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় জন্ম নেওয়া মৃণাল কলকাতায় চলে আসেন ৪০-এর দশকেই, তার পর সেখান থেকেই তার অগ্রযাত্রার গল্প শুরু। ১৯৫২-তে কলকাতায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব তাকে চলচ্চিত্র নির্মাণে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। তবে শিল্প ও চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, জানাশোনা, নিয়মিত পঠনপাঠন তৈরি হয়ে গেছে ততোদিনে। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের (IPIA) সঙ্গে ছিলো মৃণালের গভীর সখ্য। ঋত্বিক ঘটক, বিজন ভট্টাচার্য, নবেন্দু ঘোষ, শোভা সেনের মতো ব্যক্তিদের প্রধান মিলনক্ষেত্র ছিলো গণনাট্য সংঘ। এখানেই গীতা সোমের সঙ্গে পরিচয় ও পরে প্রণয়ে আবদ্ধ হন মৃণাল। পরবর্তী সময়ে মৃণালের অনেক চলচ্চিত্রে গীতা সোমকে দেখা যায় অভিনয় করতে। বস্তুত ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে রাত-ভোর চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে মৃণালের চলচ্চিত্রযাত্রা শুরু হয়। প্রথমে একজন নিবেদিত প্রাণ পাঠক ও দর্শক, এর পর লেখালেখিতে হাতেখড়ি, সবশেষে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাণে।
৫০-এর দশক ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একসময়। এই দশকেই সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের মতো দুই কালজয়ী চলচ্চিত্রশিল্পীর আবির্ভাব ঘটে। তবে এ কথা সত্যি, বাংলা চলচ্চিত্রের এই কিংবদন্তি নির্মাতা ত্রয়ী (মৃণালসহ) তাদের পূর্বসূরি নির্মাতাদের কাছ থেকে অতীত ঐতিহ্য এবং চলচ্চিত্রের পরম্পরায় উত্তরসূরি হিসেবে যা কিছু পেয়েছেন তা একেবারেই অপ্রতুল। কারণ এই ত্রয়ী পূর্ববর্তী যুগে বাংলা চলচ্চিত্র ছিলো অতি মেলোড্রামায় আক্রান্ত, সংলাপনির্ভর এক ধরনের মুভি থিয়েটার, চলচ্চিত্রের ভাষায় যার অন্য নাম ‘টকিজ’। তবে বাংলা চলচ্চিত্রের সেই মেঘে ঢাকা আকাশেও ব্যতিক্রমী ছিলো কেউ কেউ তাদের মধ্যে উজ্জ্বলতম দুটি নাম না বললেই নয়-নিমাই ঘোষ ও বিমল রায়।
এই দুই নির্মাতার চলচ্চিত্র দর্শনের ভিত্তিভূমিই ছিলো সাম্যবাদ। এদের মধ্যে নিমাই ঘোষ কেবল নির্মাতা হিসেবেই নন, আলোকচিত্রী হিসেবেও যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আর নির্মাতা হিসেবে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন ছিন্নমূল (১৯৫১) চলচ্চিত্রের জন্য। ৪৭-এর দেশভাগ পূর্ব বাংলার ব্রাত্যজন গোষ্ঠীকে (বিশেষ করে ধর্মীয়ভাবে সংখ্যায় কম লোকজন) কীভাবে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে ঠেলে দিয়েছিলো, তাদের সেই সংগ্রামমুখর জীবনেরই এক অনবদ্য দলিল ছিন্নমূল।
পাশাপাশি বিমল রায়ও তার সৃষ্টি সম্ভারে সমৃদ্ধ করে গেছেন ৪০ ও ৫০ দশকের ভারতীয় চলচ্চিত্রকে। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে শ্রেণি সংগ্রামের ভিত্তিতে নির্মিত উদয়ের পথে চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে তার বর্ণিল চলচ্চিত্র জীবনের যাত্রা শুরু হয়। একজন শিল্পী হিসেবে মানুষ ও জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতার স্বাক্ষর বহন করে এই চলচ্চিত্রটি। যার ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায় তার পরবর্তী কাজগুলোর মধ্যেও। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে সলিল চৌধুরীর কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত দো বিঘা জমিন বাণিজ্যিকভাবে সফলতা অর্জনের পাশাপাশি সমালোচক মহলেও প্রশংসা কুড়িয়েছিলো। নিউরিয়ালিজম বা নব্য-বাস্তববাদী ধারার প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবেও গণ্য করা হয় এই চলচ্চিত্রটিকে। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে কান চলচ্চিত্র উৎসবে দো বিঘা জমিন পুরস্কৃত হয়। স্বীকৃতি মেলে চিন, ইতালি ও রাশিয়া থেকেও। ১৯৫৯-এ নির্মিত সুজাতাও নব্য-বাস্তববাদী ধারা অনুসরণেই তৈরি করা হয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, সত্যজিৎ রায়কে তার চলচ্চিত্র জীবনের শেষ পর্যন্ত ইতালীয় নব্য-বাস্তববাদী ধারার অনুগত শিক্ষার্থী হিসেবে পাওয়া গেলেও এবং চলচ্চিত্রের বিশেষ এই ধারাটি সত্যজিতের হাতে সমৃদ্ধ হলেও, ভারতীয় চলচ্চিত্রে তার সূচনা হয়েছিলো বিমল রায়ের হাত ধরে, এ কথা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়।
বস্তুত ১৯৫৫-তে সত্যজিতের পথের পাঁচালী ভারতীয় চলচ্চিত্রে এক নবযুগের সৃষ্টি করে। সত্যজিৎ এই চলচ্চিত্রের ভাষায় নিয়ে এলেন আন্তর্জাতিক সুর। তিনি দেখালেন চলচ্চিত্রে কীভাবে ইমেজ ও শব্দ দিয়ে গল্প বলতে হয়। তার হাত ধরেই ভারতীয় চলচ্চিত্র পৌঁছালো বিশ্ব চলচ্চিত্রের মহাসড়কে। পাশাপাশি আরেক কালজয়ী নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক বাংলা চলচ্চিত্রকে উপহার দেন অভূতপূর্ব সব চলচ্চিত্র, যেগুলো শুধু বাংলা ভাষার নয় বরং বিশ্ব চলচ্চিত্রের ভাণ্ডারেরও অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। এই দুই নির্মাতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে মৃণাল সেন জানালেন তার আগমনি বার্তা।
তবে মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রের আঙ্গিক, বিষয়বস্তু সর্বোপরি তার উপস্থাপন রীতি ছিলো ঋত্বিক ও সত্যজিৎ থেকে একেবারেই ভিন্ন। সত্যজিৎ তার প্রথম চলচ্চিত্র থেকে শেষাবধি নানাভাবে নিউরিয়ালিজম ধারাকে অনুসরণ করে গেছেন। তার চলচ্চিত্রে দেখা যায়, মানবিক শুভশক্তির প্রতি তিনি ভীষণভাবে আস্থাশীল। হিউম্যান এনলাইটেনমেন্ট তার চলচ্চিত্রের অন্যতম উপজীব্য। নিউরিয়ালিস্টিক চলচ্চিত্রের প্রভাব আচ্ছন্ন সত্যজিৎ এই বিশেষ ঘরানার কাঠামোর উপরেই এঁকেছেন তার সহনীয় বাস্তবতার গল্প। পক্ষান্তরে ঋত্বিক ছিলেন দেশভাগের বেদনায় রক্তাক্ত আত্মার এক ডানাভাঙা শালিক। দেশভাগের যে সীমাহীন যন্ত্রণা এবং ব্রাত্য জনগোষ্ঠীর ওপর তার মানসিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিরূপ প্রভাব, সেই বীভৎস অসহনীয় বাস্তবতাকে ঋত্বিক পরম মমতায় এঁকেছেন চলচ্চিত্র ক্যানভাসে; কখনো আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন পৌরাণিক বৃক্ষের ছায়ায় যুগযন্ত্রণাকে একরকম অগ্রাহ্য করে। বর্তমানকে অস্বীকার করে অতীত আশ্রয়ী কোনো শিল্পীর গভীর মর্মবেদনার মনোলোগ যেনো তার এক একটি সৃষ্টিকর্ম।
অন্যদিকে মৃণাল অনেকটাই সমকালীন। তার বেশিরভাগ চলচ্চিত্রের গল্পই মধ্যবিত্ত অথবা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব সঙ্কট এবং তাদের সংগ্রামমুখর জীবনের প্রামাণ্য উপস্থাপন। তিনি যেনো হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির এক ভিজ্যুয়াল কথক যার চলচ্চিত্রে চিত্রায়ণ হয়েছে একটি প্রজন্মের রাগ-ক্ষোভ এবং প্রতিবাদের ভাষা। আর এভাবেই মৃণাল হয়ে উঠেছিলেন সচেতনভাবেই সমকালীন। সময়ের অভিঘাতকে তিনি নিপুণ কুশলতায় ধারণ করেছিলেন তার ফ্রেমে নিজস্ব স্বকীয়তায়। ইন্টারভিউ-এ চাকরি প্রত্যাশী বেকার যুবক, পদাতিক-এ পার্টির অভ্যন্তরীণ কর্মগুলোকে মার্কসিস্ট ডায়ালেক্টের আলোতে বিশ্লেষণ কিংবা সমালোচনার ভেতর দিয়ে সত্যান্বেষী বিপ্লবী যুবক, একদিন প্রতিদিন-এর কর্মজীবী মেয়েটি কিংবা ভুবন সোম-এর দুর্নীতিবাজ আমলা-চরিত্রগুলো সমকালীন নিমগ্ন ও সচেতন শিল্পী হিসেবেই মৃণালকে তুলে ধরে।
তিন.
মৃণালের চলচ্চিত্র জীবনকে তিনটি অধ্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম চলচ্চিত্র রাত-ভোর (১৯৫৬) থেকে ভুবন সোম (১৯৬৯) পর্যন্ত মৃণালের যাত্রাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, প্রথম চলচ্চিত্রটি মোটেও কোনো আলোচনা বা সফলতা বয়ে আনেনি তার জন্য। বরং চলচ্চিত্রটি নির্মাণ শেষে তার উপলব্ধি হয়েছিলো নির্মাণের অনেক কিছুই তার অজানা। দীর্ঘ চার বছর বিরতির পর তিনি নির্মাণ করেন দ্বিতীয় চলচ্চিত্র নীল আকাশের নীচে (১৯৫৯); এক চাইনিজ ফেরিওয়ালার কলকাতা শহরে নিঃস্ব অসহায় জীবন এবং বেঁচে থাকার লড়াইয়ের গল্প। চলচ্চিত্রটি প্রশংসিত হলেও নির্মাণের দুর্বলতা চোখ এড়ায় না। এর পর তৃতীয় চলচ্চিত্র বাইশে শ্রাবণ (১৯৬০) এ বাজিমাত করেন মৃণাল। এটা বোদ্ধা মহলে প্রশংসা কুড়ায়। চলচ্চিত্রটিকে তার ক্যারিয়ারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চতুর্থ চলচ্চিত্র পুনশ্চ (১৯৬১) তে জাতীয় পুরস্কারের সম্মান এলেও মৃণাল যেনো তখনো চলচ্চিত্রে তার একান্ত ভাষাটি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তাই অত্যর নির্মাতার যে সিগনেচার তার চলচ্চিত্রে থাকে তা তিনি যেনো খুঁজে ফিরছিলেন। এই সঙ্কট থেকে মৃণাল অনেকটাই মুক্তি পেলেন তার সপ্তম চলচ্চিত্র আকাশ কুসুম (১৯৬৫) এ এসে। এই চলচ্চিত্রে এক অন্য মৃণালকে পাওয়া গেলো, যিনি চলচ্চিত্রের গল্পটি বললেন তার স্বকীয় প্রকাশ রীতিতে। প্রচুর ফ্রিজ শটের ব্যবহার বাঙালি দর্শক দেখলো এতে। যদিও চলচ্চিত্রটি নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা করেছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ। ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় রায়-মৃণাল কলম-যুদ্ধের কথা তো এক ধরনের কিংবদন্তির মর্যাদায় পৌঁছে গিয়েছিলো। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হয়, আকাশ কুসুম-এর মাধ্যমেই একজন অত্যর নির্মাতা হওয়ার পথে মৃণাল অগ্রসর হন। যার চূড়ান্ত রূপ দেখা যায়, নবম চলচ্চিত্র ভুবন সোম (১৯৬৯) এ।
বনফুল-এর গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন মৃণাল এবং হিন্দি ভাষায় এটাই তার প্রথম চলচ্চিত্র। বস্তুত ভুবন সোম দিয়েই সর্বভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন মৃণাল। পৌঁছে যান খ্যাতির শিখরে। শুধু ভারতের জাতীয় পুরস্কারই নয়, সেই বছরই ভেনিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও ভুবন সোম-এর স্বীকৃতি মেলে। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে কান উৎসবে প্রশংসিত হয় মৃণালের এই মাস্টারপিস।
উপমহাদেশের অন্যতম চলচ্চিত্রতাত্ত্বিক অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় ভুবন সোমকে উল্লেখ করেছিলেন ‘গুজরাটের গীতি কবিতা’ বলে। মূলত মৃণালের চলচ্চিত্রের ভাষা, দর্শন ও নিরীক্ষার ক্ষেত্রে জ্যঁ লুক গদারের প্রচ্ছন্ন প্রভাব লক্ষ করা যায়। নিরীক্ষা প্রিয় মৃণাল এই চলচ্চিত্রে চূড়ান্ত রকম নিরীক্ষার প্রয়োগ দেখান। সনাতন বা প্রথাগত পদ্ধতিতে গল্প না বলে তিনি তার চলচ্চিত্রের ন্যারেটিভ নির্মাণ করেন অনেকটাই অপ্রচলিত রীতিতে। চলচ্চিত্রের গল্প বলার ক্ষেত্রে লিনিয়ার story telling থেকে সরে এসে প্রবন্ধধর্মীতার আশ্রয় নেন তিনি। চলচ্চিত্রের ব্যাকরণ ভাঙেন ইচ্ছেমতো, প্রয়োগ করেন পরীক্ষামূলক কিছু চলচ্চিত্রের টেকনিক। সবমিলিয়ে মৃণাল ভুবন সোমকে দিতে পেরেছিলেন আন্তর্জাতিকমানের চলচ্চিত্রভাষা।
চার.
মৃণালের নির্মাণে নুভেলভাগ বা ফরাসি নবতরঙ্গ (French New Wave) ধারা আন্দোলনের প্রভাব কিছুটা হলেও লক্ষ করা যায়। পাশাপাশি তিনি চ্যাপলিন, ব্রেখ্ট এবং লাতিন আমেরিকার থার্ড সিনেমা দিয়েও গভীরভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। চলচ্চিত্রের বহুমাত্রিক নিরীক্ষায় মৃণালকে কখনো দেখা যায় জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট আর্ট মাধ্যমের ব্যবহার করতে। আবার কখনো পরাবাস্তববাদের ছোঁয়ায় তিনি বলিষ্ঠ করে তোলেন তার বক্তব্যকে। সর্বোপরি অস্তিত্ববাদ এবং মার্কসবাদী দার্শনিকতায় মৃণাল বিন্যস্ত করেন তার সৃষ্টিকে। তারুণ্যের শুরুতেই মার্কসবাদে দীক্ষিত মৃণাল মানব মুক্তির অন্যতম পথ হিসেবে বিশ্বাসী ছিলেন সাম্যবাদের প্রতি; আর শোষিত বঞ্চিত, নিপীড়িত মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির অসহায় মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই মৃণাল নির্মাণ করতে এসেছিলেন চলচ্চিত্র। তাদের সঙ্কটময় জীবনের গল্পগুলোই তিনি বলে গেছেন তার প্রায় সব চলচ্চিত্রে। মধ্যবিত্তের সঙ্কট ও মূল্যবোধের অবক্ষয়গুলোকে তিনি শৈল্পিক নিপুণতায় ধারণ করেছেন তার ফ্রেমের পৃথিবীতে। কোরাস (১৯৭৫), একদিন প্রতিদিন (১৯৭৯), পরশুরাম (১৯৭৯), চালচিত্র (১৯৮১), খারিজ (১৯৮২) ইত্যাদি সেই স্বাক্ষরই বহন করে। এভাবেই মৃণাল সেন হয়ে উঠেছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থক এক কণ্ঠস্বর, তাদের অব্যক্ত কথামালার প্রাঞ্জল এক চলচ্চিত্র কথক।
পাঁচ.
সময়ের ঘড়িটাকে একটু পেছনে নিলে দেখতে পাওয়া যায়, ভারতীয় তথা কলকাতার তরুণ সমাজের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে নাই ৪৭-এর দেশভাগ তথা স্বাধীনতার ভেতর দিয়ে। তারই ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বেকারত্ব, মূল্যবোধের অবক্ষয়, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা, অস্তিত্বের সঙ্কট দিনে দিনে পুঞ্জীভূত হতে থাকে একটি প্রজন্মের হৃদয়ে। এই অবস্থা চরম আকার ধারণ করে ৬০-এর দশকের শেষ প্রান্তে। ঔপনিবেশিক ঘুণেধরা সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি হয় যুব সমাজের মধ্যে। সাম্যবাদী সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন বুকে ধারণ করে তারা দলে দলে যোগ দিতে থাকে নকশালবাড়ি আন্দোলনে। কলকাতাসহ পুরো পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা তখন একেবারেই বিশৃঙ্খল এবং নৈরাজ্যকর। সময়ের এই ঐতিহাসিক ক্রান্তিলগ্নে মৃণালের মতো সমাজ সচেতন তথা ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ শিল্পীরা তো বসে থাকতে পারে না। ৭০-এর সেই অস্থির কলকাতা এবং তার অগ্নিগর্ভ সময়কে মৃণাল তুলে আনলেন ক্যামেরার ফ্রেমে। নির্মাণ করলেন কালজয়ী কলকাতা ত্রয়ী। ১৯৭১-এ মুক্তি পেলো ট্রিলজির প্রথম চলচ্চিত্র ইন্টারভিউ। এতে মৃণাল যেনো তুলে আনলেন বর্তমান প্রজন্মের অনাস্থা, অবিশ্বাস তথা উত্তর ঔপনিবেশিক সময়ে মধ্যবিত্ত মানুষের টানাপড়েন এবং চলমান সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের গল্পকে। চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে বিবস্ত্র ম্যানিকিন যেনো উত্তর ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতা এবং অবক্ষয়ের প্রতীক হয়ে মূর্ত হলো মৃণালের সেলুলয়েডে।
এর পর যথাক্রমে কলকাতা ৭১ (১৯৭২) ও পদাতিক (১৯৭৩)। দুটো চলচ্চিত্রেই উঠে এলো ৭০-এর অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত কলকাতার সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্র। এই চলচ্চিত্রগুলোতে মৃণাল নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন একজন রাজনৈতিক সচেতন শিল্পী হিসেবে। আর এ রকম একজন শিল্পীর চোখে মার্কসবাদের অভ্যন্তরীণ দ্বান্দ্বিক ডিসকোর্সের ভিজ্যুয়াল ইন্ট্রোস্পেকশন-ই হলো পদাতিক। এই দশকে নির্মিত মৃণালের প্রতিটি চলচ্চিত্রই যেনো পুঁজিবাদী শোষণমূলক সমাজ তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিপক্ষে রাজনৈতিক প্রতিবাদের একেকটি ভিজ্যুয়াল দলিল।
ছয়.
মৃণালের দীর্ঘ চলচ্চিত্রযাত্রার তৃতীয় বা শেষ অধ্যায়ে এসে পাওয়া যায় অন্যরকম এক মৃণালের সন্ধান। বস্তুত ৮০ ও ৯০-এর দশকে এসে মৃণাল যে নির্মাণগুলো করেন সেগুলোতে ৬০Ñ৭০ দশকে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মতো মধ্যবিত্তের সমকালীন বহুমাত্রিক সঙ্কট কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতার বাহ্যিক প্রকাশ অনেকটা কমে আসে। এই পর্যায়ে মৃণাল বহির্জগতের চাইতে বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠেন তার চরিত্রদের মনোজগৎ নিয়ে। কলকাতার অস্থির উত্তাল রাজপথে ছুটে বেড়ানো মৃণালের ক্যামেরা আশ্রয় খুঁজে নেয় মধ্যবিত্তের অন্দরমহলে। তার শেষ দিকের কাজগুলোর অন্যতম উপজীব্য হয়ে ওঠে মধ্যবিত্তের অন্তর্গত মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট এবং তার অনুসন্ধান।
একদিন প্রতিদিন (১৯৭৯), খণ্ডহর (১৯৮৪), জেনেসিস (১৯৮৬), একদিন আচানক (১৯৮৯), অন্তরীন (১৯৯৩) ইত্যাদি চলচ্চিত্রে মধ্যবিত্তের প্রতি ভীষণ আস্থাশীল এবং পরম মমতাময় এক নির্মাতাকে অবলোকন করা যায়। যিনি তাদের প্রতি দায়বদ্ধতার পলিমাটিতে দাঁড়িয়ে আঁকতে চেষ্টা করেছেন তাদেরই মনোজাগতিক বহুমাত্রিক সঙ্কটের গল্পগুলোকে।
আর এভাবেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং বঞ্চিত মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ এই শিল্পী সমকালীন গণ্ডির সীমারেখা পেরিয়ে হয়ে ওঠেন সর্বজনীন মানবতাবাদী এক চলচ্চিত্রশিল্পী। যিনি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবকালেই প্রাসঙ্গিক।
লেখক : আশিক মাহমুদ, চলচ্চিত্র সমালোচক ও নির্মাতা।
ashikm1986@gmail.com
https://www.facebook.com/profile.php?id=100088366165536&mibextid=ZbWKwL
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন