রাজীব আহসান
প্রকাশিত ১৪ মে ২০২৪ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
একজন মৃণাল সেন ও তার মায়াময় করস্পর্শের অমলিন স্মৃতি
রাজীব আহসান
ধবল জোছনা হেমন্তের মৃদু কুয়াশার সঙ্গে মাখামাখি করে গলে পড়ছে কর্ণফুলির বুকে। নদীর ঝিরঝিরে হাওয়া আমার গাল ছুঁয়ে পেছনের পাহাড়ের দিকে চলে যাচ্ছে। আর আমি পাথুরে স্তব্ধতা নিয়ে রাত্রির শেষ প্রহরে বসে আছি শান্তনুদের দোতলা বাড়ির ছাদে। আমার সামনে নক্ষত্রখচিত আকাশ, কর্ণফুলি নদী আর পেছনে বৃক্ষশোভিত পাহাড়। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এই অপূর্ব লীলাময়তা আমাকে বিমোহিত করতে পারছে না, কারণ আমাকে বিমূঢ় করে রেখেছে মৃণাল সেনের খারিজ-যা ঘণ্টাখানেক আগে এই মধ্যরাতে আমি প্রথমবারের মতো দেখেছি। ছবিটি দেখার পর আমার ঘুম উবে যায়। ঘুমের দরজা পেরিয়ে উঠে আসি নৈঃশব্দময় ছাদে। আমার ভেতরটা চাপা কষ্টে হু হু করে ওঠে। আমি জানি, এটা সিনেমা, সত্যি নয়-নির্মিত চিত্র। তাহলে এমন লাগছে কেনো! আমার খুব কষ্ট লাগছে পালান-এর জন্য। খারিজ তাকে ঘিরেই আবর্তিত। পালানের মৃত্যু কি আমি মেনে নিতে পারছি না? না কি আমাকে তাড়িত করে ফিরছে সন্তানহারা পালানের বাবার ব্যথাতুর অভিব্যক্তিময় ক্লোজআপ, কিংবা গৃহকর্মী পালানের মৃত্যুতে অপরাধবোধে আক্রান্ত অঞ্জন দত্ত ও মমতা শঙ্করের মুখাবয়ব। রমাপদ চৌধুরীর এই আখ্যানটিকে অসাধারণভাবে অ্যাডাপ্ট করেছেন মৃণাল। কোনো বাহুল্য নেই সিনেমাটির শরীরজুড়ে। ব্যবহার করেছেন পরিমিত সংলাপ। আর একে একে উন্মোচন করেছেন বাঙালি মধ্যবিত্তের মুখোশ।
কর্ণফুলি নদীতে ভোর নেমে আসে। ভোরের হিম হাওয়ার ঝাপটা লাগে শরীরে। ছাদ থেকে নেমে দেখি শান্তনুদের বাসার সবাই ঘুমাচ্ছে। কাল এমনই এক ভোরে সারারাত বাস জার্নি করে বন্ধু শান্তনুদের কাপ্তাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম। দিনটি কেটেছিলো ঘুমে-ঘুমে। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও আমার ঘুম আসছিলো না। তাই সঙ্গে নিয়ে আসা মৃণালের তিনটি ছবি থেকে খারিজ দেখে ফেলা।
দুপুরের আহারান্তে শান্তনু নিয়ে যায় কাপ্তাই লেক ঘুরে দেখাতে। ভাড়া করা নৌকা চলতে থাকে। আমার চোখ কাপ্তাইয়ের মনোরম সৌন্দর্য দেখতে থাকলেও মন পড়ে থাকে মৃণালের সিনেমায়। মাথার ভেতরে প্রোথিত খারিজ আর কোনোভাবেই বের হয় না। কাপ্তাই ভ্রমণ শেষে ফিরে এসে দেখতে শুরু করি ইন্টারভিউ। কিছুক্ষণ দেখার পর আঁতকে উঠি। এমন ছবি তো আগে দেখিনি কখনো! সিনেমা শুরুর প্রায় ২০ মিনিট অতিক্রান্ত হওয়ার পর একটি দৃশ্যে প্রোটাগনিস্ট রঞ্জিত মল্লিক ট্রামে উঠেন। দর্শক দেখে ট্রামের এক যাত্রী বার বার রঞ্জিতের দিকে তাকাচ্ছেন। যাত্রীর হাতে থাকা ম্যাগাজিনের শিরোনাম দেখা যায়-“মৃণাল সেনের নতুন ছবি ‘ইন্টারভিউ'-এর নায়ক রঞ্জিত মল্লিক”। ট্রামের বালিকা যাত্রী একবার ম্যাগাজিনের দিকে, একবার রঞ্জিত মল্লিকের দিকে তাকাচ্ছে। রঞ্জিত মল্লিক ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজেকে লুকোনোর চেষ্টা করেন। এইসব দেখে বালিকাকে অন্য এক বয়স্ক যাত্রী বলেন-‘হচ্ছেটা কী!’ রঞ্জিত মল্লিক সমস্ত আড়ষ্টতা ভেঙে বলতে শুরু করেন-
দেখুন মশাই, দোষটা আমার। আপনাদের হয়তো একটা বিশাল কৌতূহল হচ্ছে ... হচ্ছে তো? দেখুন, আপনাদের কাছে কিছু গোপন করবো না। পত্রিকায় যে ছবিটি দেখছেন ওটা আমারই ছবি। (তারপর ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দর্শকের উদ্দেশ্যে রঞ্জিত মল্লিক বলেন) দেখুন, অভিনেতা বলতে যা বোঝায় আমি তা নই, আমি স্টার নই ... একেবারেই নই। আমার নাম রঞ্জিত মল্লিক। আমি একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করি। থাকি ভবানীপুরে। এই টুকিটাকি কাজ, এই ধরুন প্রুফ দেখা ... প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে প্রেসের যাবতীয় কাজ ... এটা ওটা-এমনকি বিজ্ঞাপন জোগাড় করা ... তাগাদা দেওয়া-সব। ভীষণ আনইভেন্টফুল লাইফ মশাই আমার। এটাই মৃণাল সেনের-ওই যে ভদ্রলোক ছবি-টবি করে-ওনার খুব ভালো লেগে গেলো। আমাকে বললেন, ঠিক আছে ... তোমাকে ঠিক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্যামেরা নিয়ে তাড়া করবো। বলুন তো মশাই, কোনো মানে আছে?
দর্শকের চোখে চোখ রেখে রঞ্জিতের বলা কথাগুলো শেষ হলে পরের শটে সত্যি সত্যিই দেখি ক্যামেরা দিয়ে শ্যুট করে চলছেন কে কে মহাজন। এই অভিনব শৈলী আমাকে চমকিত করে। তখনো আমি ব্রেখট পড়িনি। মৃণাল সেনের ফর্ম ও এক্সপেরিমেন্টের প্রেমে পড়ে যাই আমি। আমার ভাবনার জগতে ইন্টারভিউ ভীষণভাবে প্রভাব ফেলে।
রাতেই দেখে ফেলি সঙ্গে থাকা তৃতীয় সিনেমা খন্ডহর। এটা হিন্দি ভাষায় নির্মিত। শাবানা আজমি, নাসিরুদ্দিন শাহ ও গীতা সেনের কী অনবদ্য অভিনয়! লোকেশন, বিশেষ করে ভাঙা বাড়িটিকে আমার মনে হতে থাকে সিনেমার প্রধান চরিত্র। প্রতীক্ষা কতো ভয়াবহ হতে পারে তা এই সিনেমা দেখে অনুধাবন করেছিলাম। খন্ডহর যখন শেষ হয়, তখন যামিনীর (শাবানা আজমি) জন্য এক ধরনের মায়া অনুভব করেছিলাম। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার' গল্পের অ্যাডাপ্টেশন খন্ডহর। পরবর্তী সময়ে গল্পটি পড়ে বুঝেছিলাম, অ্যাডাপ্টেশন কতো বিস্তৃত হতে পারে। মৃণাল গল্পের মূল নির্যাস ঠিক রেখে কতো কিছু যে যোগ-বিয়োগ করেছেন! আমার মনে হয়, অ্যাডাপ্টেশনের ক্ষেত্রে খন্ডহর অবশ্য পাঠ্য চিত্রনাট্য।
দুই.
পরদিন ফিরে আসি ঢাকায়। আমি তখন পুরোপুরি মৃণালীয় ঘোরে আচ্ছন্ন। তার বাকি সিনেমাগুলো দেখার জন্য উদগ্রীব। এদিকে রাঙামাটি ও কাপ্তাই ঘুরে আমার পকেট শূন্য। অগত্যা বন্ধু কাজী মামুন হায়দারের কাছ থেকে টাকা ধার করে ছুটলাম রাইফেল স্কয়ারের দিকে। ‘মুভি প্লাস’ দোকান থেকে কিনলাম মৃণাল সেনের সিনেমাগুলোর ডিভিডি। তখনো ডিভিডির যুগ শেষ হয়নি, তবে শেষের দিকে। যদিও সবগুলো সিনেমা পাওয়া যায়নি। তারপরও নিয়ম করে প্রতিদিন দুটো করে সিনেমা দেখা শুরু করলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা দেখি। তার পর কিছুক্ষণ ভাবি। দুপুরের খাবারের পর আরেকটা দেখি। অতঃপর কিছুক্ষণ ছবিটি নিয়ে ভেবে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই মনিপুরীপাড়ায় তারেক মাসুদের বাসায়। তারেক ভাইয়ের সঙ্গে সদ্য দেখা সিনেমাগুলো নিয়ে চলে দীর্ঘ আলাপচারিতা। তারেক ভাই তরুণদের খুব প্রশ্রয় দিতেন, ভালোবাসতেন। মৃণালের সিনেমা নিয়ে আমার অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি। ভুবন সোম-এর অ্যাডাপ্টেশন; কলকাতা ৭১ কেনো বাঙালির দীর্ঘ বেদনার খণ্ডচিত্র; মার্কসিস্ট হওয়ার পরও পদাতিক কেনো প্রোপাগান্ডা ফিল্ম নয়; মৃগয়ায় মিঠুন চক্রবর্তীর বিচারের দৃশ্য; ওকা উরি কথায় মমতা শঙ্করের প্রসব বেদনার দৃশ্য; একদিন প্রতিদিন-এ পুরুষ প্রাধান্যশীল সমাজব্যবস্থাকে কীভাবে চপেটাঘাত করা হয়েছে; আকালের সন্ধানের ফিল্ম উইদ-ইন ফিল্ম; চালচিত্রর ধোঁয়াময় স্বপ্নদৃশ্য; জেনেসিস-এ শাবানা আজমি, নাসিরুদ্দিন শাহ ও ওম পুরির অনবদ্য অভিনয়-এসব বিষয় নিয়ে তারেক ভাইয়ের সঙ্গে হতো দীর্ঘ আলাপচারিতা। মৃণালের একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তারেক মাসুদ। তারেক ভাইয়ের বাসায় সেটা শুনেছিলাম আমি। আড়াই-তিন ঘণ্টার সাক্ষাৎকার। অমূল্য সেই সাক্ষাৎকারটি কোথাও প্রকাশ হয়েছে কিনা জানি না। হায়, তারেক ভাইও আজ আমাদের মাঝে নেই!
তিন.
কিছুদিন পর শাহবাগের আজিজ মার্কেটে বইয়ের দোকানে পেয়ে যাই মৃণাল সেনের বই ‘চার্লি চ্যাপলিন’। কী দারুণ বই! চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের পাশাপাশি লেখক মৃণালকেও আমার ভালো লেগে যায়। কিছুদিন পর ‘দেশ’ পত্রিকায় মৃণালের আত্মজীবনী ‘তৃতীয় ভুবন' নিয়ে চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষের একটা রিভিউ পড়ি। গৌতম দার রিভিউ পড়ে আর এক মিনিট দেরি করিনি। সোজা আজিজ মার্কেটে গিয়ে ‘তৃতীয় ভুবন' কিনে বাসায় ফিরি। ২৭০ পৃষ্ঠার সেই বই পড়ে ফেলি একটানে। ফরিদপুরে কাটানো শৈশব, কৈশোর ও প্রারম্ভিক যৌবনের দিনগুলো মৃণাল বর্ণনা করেছেন তার অনুপম গদ্যে। ছোটো বোনের মৃত্যু, বাবার ওকালতি ও রাজনীতি, বাসায় নেতাজী সুভাষ বসুর আগমন, বড়ো ভাইয়ের বন্ধু কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে সখ্য-এই অংশের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এর পর পড়ালেখার জন্য মৃণাল চলে আসেন কলকাতায়। জড়িয়ে পড়েন সাংস্কৃতিক নানা ক্রিয়া-কর্মে। বন্ধু হিসেবে পান সলিল চৌধুরী, তাপস সেন, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখদের। চলচ্চিত্রকার হওয়ার প্রস্তুতিও নেন। কিন্তু জীবনযুদ্ধের নির্মমতায় তাকে নিতে হয় ওষুধ কোম্পানির মেডিকেল প্রতিনিধির চাকরি। পোস্টিং হয় কানপুরে। ছয় মাসেই হাঁপিয়ে ওঠেন মৃণাল। স্বপ্ন যার সেলুলয়েডের রুপালি ফিতায় মানুষের গল্প গাঁথার, তার কী এইসব ভালো লাগে! ‘তৃতীয় ভুবন’-এর ৬৯-৭০ পৃষ্ঠায় মৃণাল বলেন এভাবে-
এ কী! এ কী করছি! বলা নেই কওয়া নেই, এক এক করে নিজেকে খুলে ফেললাম। বিবস্ত্র।... তারপর... কথা বলতে শুরু করলাম আমি আমারই সঙ্গে। আমার ‘ডাবল'-এর সঙ্গে। চোখে চোখ রেখে। উলঙ্গ।
বললাম, ‘কি হে মৃণাল সেন, তুমি না ছবি করতে চেয়েছিলে! সিনেমার ওপর অনেক পড়াশোনা করেছ, সিনেমার নান্দনিক দিক নিয়ে অনেক ভেবেছ, অনেক লিখেছ, অনেক চেষ্টা করেছ তোমার পাঠককে চমকে দিতে, ভানুমতীর খেলা খেলতে। আসলে তুমি কিন্তু দাওয়াইওয়ালা, এই দোকান থেকে ওই দোকানে গিয়ে ওষুধ বিক্রি করে বেড়িয়েছ। এসব কী করতে গিয়েছিলে। মৃণাল সেন?
... হঠাৎ মনে হল বুকে একটা চাপ পড়ছে। মনে হল গলায় কি একটা উঠে আসছে। তাকিয়ে আছি চোখে চোখ রেখে। চোখ কি ছলছল করছে? কে, না তো। সেই মুহূর্তে কি হল, নিজেকে ভ্যাংচাতে শুরু করলাম, নানাভাবে, অসভ্যের মতো, কখনও চোখ ঢেকে, কখনও বা খুলে, আবার এক-চোখা হয়েও বা। আর আমার মুখোমুখি আমি। এবার সত্যিই গলা ভিজে এল। কাঁদব কি! ... কাঁদছি পাগলের মতো, কাঁদছি শিশুর মতো, কাঁদছি হাউহাউ করে। আমি একা, একা ঘরে, নিঃসঙ্গ। ...
... আমি কাজে ইস্তফা দিলাম। ফিরে আসার জন্য নয়। চলে যাওয়ার জন্য। কলকাতায় থেকে যাওয়ার জন্য।
আবার সেই কলকাতা, আবার সেই প্যারাডাইস কাফে, আবার গীতা, ...
আমি যখনই হতাশায় তলিয়ে যাই, তখন ‘তৃতীয় ভুবন’ এর শ্বাসরুদ্ধকর এই পৃষ্ঠাটা পড়ি। হয়তো অনুপ্রাণিত হওয়ার জন্য, হয়তো বেঁচে থাকার জন্য।
চার.
মৃণালের ‘তৃতীয় ভুবন' পড়ার পর থেকে ওর সঙ্গে দেখা করার প্রবল ইচ্ছে জাগে। অনেক প্রশ্ন ওঠে মনে। তার সিনেমাগুলোর কান-বার্লিন-ভেনিস যাত্রার কথকতা আরো বিস্তারিতভাবে শুনতে ইচ্ছে করে। তার অ্যাডাপ্টেশনের মুগ্ধতা নিয়ে আমার জমানো কথাগুলোও তাকে বলতে মন চায়। তার কাছে থেকে জানতে, শিখতে ইচ্ছে করে কতো কিছু! তাই বন্ধুদের সঙ্গে সিনে-আড্ডায় ঘোষণা দিই-‘আমি দ্রুতই কলকাতা যাচ্ছি মৃণাল সেনের সঙ্গে দেখা করতে।’
দিন যায়, রাত যায়, মাস যায়, এমনকি বছরও চলে যায়; আমার আর যাওয়া হয় না। সিনে-আড্ডায় মৃণালের প্রসঙ্গ আসতেই বন্ধু চলচ্চিত্রকার জাবের হাসান বলে বসে, ‘রাজীব ভাই, একটা কথা বলি, কিছু মনে করবেন না। আপনি অনেকদিন ধরে একই কথা বলছেন, মৃণাল সেনের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন, কিন্তু যাচ্ছেন না। এইবার যদি না যান, তাহলে ওর সঙ্গে কিন্তু আপনার আর দেখাই হবে না।' শ্মশ্রুমণ্ডিত জাবেরের গাম্ভীর্যপূর্ণ প্রফেটসুলভ কথা আমাকে বিচলিত করে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোন করি খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষ দাদাকে। গৌতম দা বলেন, ‘তুমি যদি দু-চার দিনের মধ্যে দেখা করতে চাও, তাহলে আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আর যদি ২০ দিন অপেক্ষা করো, তাহলে আমার সঙ্গেই যেতে পারো। ১৪ মে মৃণাল দা'র জন্মদিনে আমি শুভেচ্ছা জানাতে যাবো।' আমি গৌতম দাকে বলি, ‘দাদা, আমি আপনার সঙ্গেই যাবো।’
২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মে’র রৌদ্রজ্জ্বল সকালে বাংলাদেশ বিমানে কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা করি। বিমান উড্ডয়নের প্রাক-কালে পাইলট হিসেবে একজন নারীর নাম ঘোষিত হয়। ঘোষণা শেষ হওয়া মাত্র আমার ঠিক পেছনের সিটের ষাটোর্ধ্ব এক পুরুষ যাত্রী উচ্চস্বরে দোয়া-দরুদ পড়তে থাকে। বিমান চলাকালে প্রায় ৪৫ মিনিটই তিনি দোয়া-দরুদ আর নারীবিদ্বেষী কথাবার্তা বলতে থাকেন এবং নারী পাইলট ঠিক মতো ল্যান্ড করাতে পারবে কিনা তা নিয়ে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। যাইহোক, ঠিক মতো ল্যান্ড করার পর যখন প্লেন থেকে বেরিয়ে আসি তখন লোকটিকে শুধু বললাম, ‘আপনাকে যদি একজন নারী এই পৃথিবীতে ল্যান্ড করাতে পারে, তাহলে সামান্য বিমান ল্যান্ড করাতে পারবে না!' লোকটি ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
হোটেলে ফিরে গৌতম দাকে ফোন দিই। দাদা বলেন, ‘আগামীকাল সকাল ১০টার মধ্যে আমার বাসায় চলে এসো। এখান থেকে একসঙ্গে যাবো।' কথা মতো পরদিন ১০টার আগেই গৌতম দার বাসায় হাজির হই। তার পর জিপ টাইপের একটা গাড়িতে করে গৌতম দা, খুকু দি (নীলঞ্জনা ঘোষ) ও আমি মৃণাল সেনের বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করি। পথিমধ্যে গৌতম দা মৃণাল সেনের জন্য বিখ্যাত এক দোকান থেকে লাড্ডু নেন, আর আমি নিই এক তোড়া ফুল। গাড়িতে যেতে যেতে গৌতম দা মৃণাল সেনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ওর নানা ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে থাকেন। মাঝে মাঝে স্মৃতিচারণায় যোগ দেন খুকু দি-ও। গাড়ি থামে মৃণাল সেনের বাড়ির সামনে।
পাঁচ.
মৃণালের আজ ৯৬তম জন্মদিন। ঘর ভর্তি মানুষ আর মানুষ। চলচ্চিত্রকার, সমালোচক, সাংবাদিক গিজ গিজ করছে। সকাল থেকে শুভেচ্ছা নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন মৃণাল। তাই আপাতত তাকে নিভৃতে রাখা হয়েছে। গৌতম দা লাড্ডুর প্যাকেটটি মৃণালের একমাত্র সন্তান কুণাল সেনের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘এই লাড্ডু মৃণাল দার খুব পছন্দের, গীতাদিরও প্রিয় ছিলো, খাইয়ে দিস।' মৃণাল সেনের জন্য নেওয়া ফুলের তোড়া আমি কুণাল সেনের হাতে তুলে দিই। কুণাল ভিড় ঠেলে আমাদের তিনজনকে ভেতরে নিয়ে যান। দেখি, মৃণাল সেন কাত হয়ে শুয়ে আছেন। গৌতম দা ওর কাছে গিয়ে মাথায় হাত রাখলেন। গৌতম দার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন খুকু দি। খাটের অন্য পাশে আমি আর কুণাল সেন। গৌতম দা দুই-একটা কথা বললেন। তার পর আমাকে ইশারা করে গৌতম দার কাছে যেতে বললেন। আমি কাছে গিয়ে হাত বাড়াতেই মৃণাল তার হাতটি বাড়িয়ে দেন। গৌতম দা বললেন, ‘ওর নাম রাজীব আহসান। শুধু আপনাকে দেখতে এসেছে বাংলাদেশ থেকে। দুটো শর্টফিল্ম বানিয়েছে। ফুল লেন্থ বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।' মৃণাল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাংলাদেশ থেকে ... ।' ওর কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিলো। আমি শুধু বললাম, ‘আপনি আমার ভীষণ প্রিয় ফিল্মমেকার।' আর কিছুই বলতে পারলাম না। তিনি আমার হাত ধরে আছেন কিন্তু কিছু বলছেন না-শিশুদের মতো হয়ে গেছেন। আমার অনেক খারাপ লাগছিলো তাকে এইভাবে দেখে। গৌতম দা বললেন, ‘মৃণাল দা এবার আমরা যাই।' মৃণাল কিছুই বলছেন না, আমার হাতটাও ছাড়ছেন না। আর আমিও চাচ্ছি না আমার হাতটি ছাড়িয়ে নিতে। গৌতম দা এগিয়ে গিয়ে শরীরে হাত বুলিয়ে দেওয়ায় তিনি আলতো করে আমার হাতটি ছেড়ে দিলেন। আমরা ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। গৌতম দা বিভিন্ন মিডিয়ায় মৃণাল সেনের কাজ নিয়ে কিছুক্ষণ বললেন। অতঃপর আমরা কুণাল সেনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। কুণাল সেন আমাকে ধন্যবাদ দিলেন বাংলাদেশ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে যাওয়ার জন্য।
গাড়ি ছুটে চলছে গৌতম ঘোষের বাড়ির দিকে। গৌতম দা বললেন, ‘মৃণাল দা হয়তো আর খুব বেশিদিন আমাদের মাঝে থাকবেন না।' আমি বললাম, ‘আমার মনে হয় সেঞ্চুরি না করে তিনি যাবেন না।' গৌতম দার কথাই সত্যি হলো। জন্মদিনের ঠিক সাড়ে সাত মাস পর এক কুয়াশামাখা বিষণ্ন দিনে তিনি বিদায় নিলেন। আমার জমে থাকা কথাগুলো আর বলা হলো না।
প্রিয় মৃণাল সেন, আপনাকে, আপনার লেখা, আপনার চলচ্চিত্র, আপনার দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে ফেলা চলচ্চিত্রের ভাষাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। আপনার হাতের স্পর্শ এখনো অনুভূত হয়।
লেখক : রাজীব আহসান, চলচ্চিত্রনির্মাতা।
razibaahsan@gmail.com
https://www.facebook.com/razib.ahsan.14
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন