Magic Lanthon

               

কৌশিক গাঙ্গুলি

প্রকাশিত ১৮ মে ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

চলচ্চিত্র বানানোর জন্য সবসময়ই গল্পের প্রয়োজন হয় না : কৌশিক গাঙ্গুলি

কৌশিক গাঙ্গুলি

 

কৌশিক গাঙ্গুলির জন্ম কলকাতায় ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট। বাবা সুনীল গাঙ্গুলি ছিলেন ভারতের বিখ্যাত গিটারবাদক। কৌশিক নরেন্দ্রপুরের রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে নিয়ে পড়াশোনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন ভাবী স্ত্রী চূর্ণী গাঙ্গুলি ও বন্ধু সুমন মুখোপ্যাধ্যায়কে (চলচ্চিত্রনির্মাতা) সঙ্গে নিয়ে একটি থিয়েটার ট্রুপ শুরু করেছিলেন। এরপর ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে চলচ্চিত্র অঙ্গনে পা রাখেন চিত্রনাট্যকার হিসেবে। কিছু বছর চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ করার পর ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ওয়ারিশ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত ২৬টির মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। এছাড়াও তিনি তারিখ, শঙ্করমুদি, বিজয়াসহ বেশকিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পেয়েছে অর্ধাঙ্গিনীপালান। মৃণাল সেনের শতবর্ষ উপলক্ষে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে খারিজ এর সিক্যুয়াল হিসেবে পালান নির্মাণ করেন। সম্প্রতি সাহিত্য ম্যাগাজিন বিষয়ক ওয়েবসাইট theSpace.ink এ কৌশিক গাঙ্গুলি তার জীবনদর্শন সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করেছেন এবং কীভাবে মৃণালের জীবনদর্শনকে নিজের কাজে ব্যবহার করেছেন সে সম্পর্কে বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হয়েছে ৪ জানুয়ারি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে এবং নিয়েছেন শোলি চক্রবর্তী; তিনি পেশায় একজন সাংবাদিক ও লেখক, এছাড়াও রেডিওতে উপস্থাপক হিসেবেও কাজ করেন।

শোলি চক্রবর্তী : অন্য কোনো চলচ্চিত্রকে না বেছে মৃণাল সেনের খারিজ এর সিক্যুয়াল নির্মাণের সিদ্ধান্তই কেনো নিলেন?

কৌশিক গাঙ্গুলি : সময়টা ১৯৮২, সম্ভবত তখন আমি ষষ্ঠ অথবা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। মৃণাল সেনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে খারিজ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। যখন আমি চলচ্চিত্র সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতাম না। বইপুস্তক পড়ে সবে আমি কার্বন মনোঅক্সাইড সম্পর্কে জেনেছি। তাই যখন আমি চলচ্চিত্রটি দেখি তখন সত্যিই অনেক মুগ্ধ হয়েছিলাম। চলচ্চিত্রটিতে আমার বয়সি একটি ছেলে চরিত্র; যে এক মধ্যবিত্ত বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে এবং সেখানে কাজ করতে গিয়ে তার রহস্যজনক মৃত্যু হয়। গল্পটা আমার কাছে একান্ত নিজের মনে হয়েছে, যেটা আমার জন্য বিরাট ব্যাপার। এমনকি যে বাড়িতে আমি বড়ো হয়েছি, সেখানে এক গৃহকর্মী বাবা-মা তরুণ ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো খাওয়ানোর সামর্থ্য না থাকায় প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই তারা তাদের সন্তানদের কাজে পাঠাতেন। কারণ তারা খুব দরিদ্র অবস্থান থেকে এসেছিলো। এবং তাদের অবস্থা এতোটাই খারাপ ছিলো যে, কাজ করা ছাড়া তাদের কোনো উপায় ছিলো না। এমনকি আমাদের বাড়িতে এক মহিলাও কাজ করতেন। অবশ্য ওনার ছেলেমেয়ে তখন স্কুলে যেতো; পাশাপাশি ঘরের কিছু কাজও করতো। এ রকম অনেক অল্প বয়সী ছেলে ছিলো, যারা বছরের পর বছর আমাদের জন্য কাজ করতো।

সুতরাং আমার বয়সও প্রায় একইরকম হওয়ায় আরো ভালোভাবে চলচ্চিত্রের মধ্যে ঢুকতে পেরেছিলাম।

শোলি : এরপর আপনি বড়ো হয়ে কী করলেন?

কৌশিক : যখন আমি বড়ো হয়ে আবার খারিজ দেখি, তখন নতুন করে এই চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ খুঁজে পাই। একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে আমি উপলব্ধি করেছি চলচ্চিত্র বানানোর জন্য সবসময়ই গল্পের প্রয়োজন হয় না। সত্যিকার অর্থে আপনার যেটা প্রয়োজন সেটা হলো একটা পরিস্থিতি। এবং সেই বিশেষ পরিস্থিতি আপনার চারপাশের মানুষ কিংবা গোটা সমাজের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে; চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ব্যস এতোটুকুই যথেষ্ট। এ ক্ষেত্রে কেবল বিনোদনের জন্য গল্প বানোনোর কোনো প্রয়োজন নেই। বরং মানুষ হিসেবে আমরা যে ধরনের আবেগ, মানসিক অস্বস্তি, উদ্বেগ এবং জীবনের বিভিন্ন উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাই, সেগুলোই চলচ্চিত্রে কাজ করার জন্য যথেষ্ট। বলা যায়, এভাবেই আমি নির্মাতা মৃণাল সেনকে আবিষ্কার করেছি।

শোলি : এতো বছর পর একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে আপনার ওপর মৃণাল সেন ঠিক কতোটা প্রভাব ফেলতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন?

কৌশিক : আমার কাছে মৃণাল সেন হলেন প্রথম কোনো নির্মাতা, যার চলচ্চিত্র আমরা যে সমাজে বাস করি সেই সমাজের চাপা বা আড়ালে থাকা পরিস্থিতি ও সমস্যাগুলোকে তুলে ধরে। এই ধরনের চলচ্চিত্রকে বিশ্বজুড়ে সম্মান করা হয়, প্রশংসিতও হয়। তাই আমি তখন থেকেই সিদ্ধান্ত নিই যে, নির্মাতা হলে এমন একজন নির্মাতাই হবো, এই ধরনের চলচ্চিত্রই বানাবো। মৃণালের জন্ম শতবর্ষে তার জীবন ও আর্দশকে উদযাপন করতে চেয়েছিলাম। খারিজ-এর মতো একই ধরনের অভিনয়শিল্পী ও চরিত্র চেয়েছিলাম। কারণ চলচ্চিত্র্র নির্মাণের ভিন্ন কিন্তু সংবেদনশীল পদ্ধতিতে এই অভিনয়শিল্পীদের চরিত্রগুলোকে পর্দায় তুলে আনতে চেয়েছিলাম।

শোলি : মৃণাল সেনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আর কোনো চলচ্চিত্র বানানোর পরিকল্পনা আছে আপনার? আপনি কি মনে করেন মানুষ সত্যজিৎ রায়ের শতবর্ষের বছরটা নিয়ে যেভাবে আগ্রহী ছিলো, মৃণাল সেনের শতবর্ষ নিয়ে তেমন কোনো প্রস্তুতি আছে কি?

কৌশিক : মৃণালকে শ্রদ্ধা জানাতে আর কোনো চলচ্চিত্র বানাচ্ছি না। পালান একটাই। দেখেন, মানুষ যখন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে কাউকে শ্রদ্ধা জানানোর পরিকল্পনা করে, তখন দুটি উপায়ে সেটা করতে হয়প্রথমত, আপনি একটি বায়োপিক তৈরি করতে পারেন; দ্বিতীয়ত সেই ব্যক্তির আদর্শের ওপর ভিত্তি করে একটি চলচ্চিত্র বানাতে পারেন। এখানে আমি দ্বিতীয় পদ্ধতিটাই বেছে নিয়েছি। অর্থাৎ আমি মৃণালের আদর্শ ও জীবনদর্শন নিয়ে কাজ করতে চেয়েছি। নির্মাতা হিসেবে আমি আমার কাজের মাধ্যমে একজন নির্মাতার নির্মাণশৈলী ও তার কাজের পরিসরকে তুলে ধরতে চেয়েছি। তবে অনেকেই আছে যারা ব্যক্তির জীবনযাত্রাকে আধেয় করে চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানানোর পরিকল্পনা করে। ফলে এ নিয়ে মানুষের দুটি ভিন্ন ধরনের মতামত রয়েছে। অপুর পাঁচালীর মাধ্যমে শতবর্ষের অনেক আগেই আমি সত্যজিতকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলাম। এটা আমার কাজের কৌশল। অন্য নির্মাতারা যেভাবেই মৃণাল সেনের প্রতি শ্রদ্ধা জানান না কেনো, একজন নির্মাতা হিসেবে আমি আমার সব সহ-নির্মাতাদের মঙ্গল কামনাই করতে চাই।

শোলি : কীভাবে আপনি চলচ্চিত্রের সেট নির্বাচন করেছেন; যেমন চলচ্চিত্রের ওই নির্দিষ্ট বাড়িটি?

কৌশিক : খারিজ বার বার দেখার পর আমি আসলে কী করতে চাই সে বিষয়ে মোটামুটি একটা ধারণা তৈরি হয়েছিলো। দেখেন, সেনের চলচ্চিত্রে বাড়িটা আসলে একটা সেট ছিলো। এটা কোনো আসল বাড়ি নয়, নীতীশ রায়ের তৈরি করা দোতলা সেট ছিলো। যেকারণে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে নীতীশ রায় খারিজ-এর শিল্পনির্দেশনার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছিলেন। তাই এই ৪৪ বছর পরে এসে ওই একই ধরনের ও তার পরিবেশের সঙ্গে মানানসই বাড়ি খুঁজে পাওয়াটা ভীষণ চ্যালেঞ্জিং ছিলো। আমি ওই সেটের কোনো অনুলিপি করতে চাইনি। তবে আমি এমন একটি বাড়ি চেয়েছিলাম যেটা আমার নান্দনিকতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে যাবে। উদাহরণস্বরূপ যদি কোনো একটি গান একজন পুরুষ ও একজন নারী যুগলে গায়, তখন এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা স্বাদ যোগ করবে। একইভাবে আমার মনে হয়েছে বাড়িটা যদি গল্পের একটা চরিত্র হয়, তবে সেটা সেট ও আসল বাড়ি এই দুইয়ের অস্তিত্বের গল্প বলতে পারবে; যেটা গল্পে সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা যোগ করবে।

শোলি : একটা মনস্তাত্ত্বিক গল্প; যেখানে ধারাবাহিকভাবে দ্রুতগতিতে কিছু না কিছু ঘটে চলেছে, একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে এমন একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করা আপনার জন্য কতোটা সহজ অথবা কঠিন ছিলো?

কৌশিক : হ্যাঁ, এমন কিছু চলচ্চিত্র আছে যেখানে আবেগময়তা ও অশান্তিতে ভরা দৃশ্যগুলো একের পর এক পর্দায় ফুঁঠে ওঠে, এটাও চলচ্চিত্র নির্মাণের একটা ধরন। কিন্তু আমাদের জীবন সবসময় এমন হয় না। বেশিরভাগ সময় আমাদের জীবন খুব সাধারণভাবে এগিয়ে যায়, কখনো কখনো ধীর গতিতে। বিশেষ করে আপনি যদি ৭০ বছর বয়সি কোনো লোকের দিকে তাকান, দেখবেন তাদের জীবন অনেক ধীর। আমার চলচ্চিত্রে অঞ্জন সেনের মতো কাউকে দরকার ছিলো, যে হেঁটে চলাফেরা করেন। এই ধরনের মানুষদের জীবন খুব ধীর গতিতে চলে। এই মানুষগুলোকে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সমর্থন প্রয়োজন। সেটা হতে পারে হাঁটার সঙ্গী কিংবা তাদের কাছের কেউ। এই মানুষগুলোর দৈনন্দিন সংগ্রামকে তুলে ধরা অবশ্যই আরো বেশি কঠিন কাজ। এ জাতীয় চলচ্চিত্রে সংবেদনশীলতার চাইতে হাইপ (বাড়িয়ে বলা) বেশি থাকে। এটাই ‘সিনেমা ও চলচ্চিত্রের পার্থক্য। এবং এমন চলচ্চিত্রগুলোতে নির্দিষ্ট কোনো চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলোকে বের করে আনার জন্য ছোটো ছোটো কিছু বিষয় থাকে; একজন ব্যক্তির আদর্শকে গভীরভাবে নাড়া দিতে হবে এবং বাস্তবসম্মতভাবে তার ভুলগুলোকে বের করে আনতে হবে। পালান এ এই বিষয়গুলোকে অনেকটাই তুলে আনতে পেরে আমরা ভীষণ আনন্দিত।

শোলি : পালান যে ধরনের চলচ্চিত্র সেটা বিবেচনায় নিয়ে বক্স অফিসের সাফল্য আপনার কাছে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ?

কৌশিক : পালান সেই ধরনের চলচ্চিত্র নয় যা শুরু থেকেই বক্স অফিসে বিরাট একটা টাকার অঙ্ক নিশ্চিত করতে পারে। বরং দর্শককে সংবেদনশীল করবে, এমন একটি চলচ্চিত্র পালান। পশ্চিমবঙ্গে এমন শত শত লোক আছে যারা রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় না। কিন্তু ‘যাওয়া শব্দ শুনেই আমরা বুঝতে পারি টুম্পা সোনা গানটা কতোজন গাইবে। বাসে, অটোতে, রিকশাতে, পানের দোকানসহ সবখানে আপনি টুম্পা সোনা গানগুলো শুনতে পাবেন, কিন্তু এ ধরনের জায়গাগুলোতে রবীন্দ্রসঙ্গীত খুব কমই শোনা যায়। অর্থাৎ সমাজে সবকিছ্রুই নিজস্ব জায়গা আছে। এই গানগুলো বিভিন্ন চিন্তাধারা ও সঙ্গীতের বিভিন্ন ঘরানা থেকে আসে। একইভাবে, বাংলার মানুষ জানে না বিখ্যাত চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সম্পর্কে; যারা প্রকৃতঅর্থেই ভালো কিছু কাজ করেছে।

আবার এই একই মানুষেরা অভিনয়শিল্পী (নারী-পুরুষ উভয়) সম্পর্কে জানবে কিন্তু নির্মাতা কিংবা শিল্পনির্দেশনা সম্পর্কেও জানতে আগ্রহী হবে। আসলে দর্শকের মনস্তত্ত্ব বড়োই অদ্ভূত। কয়েক বছর আগেও জনপ্রিয় ও অর্থবহ চলচ্চিত্রের মধ্যে বিরাট একটা ব্যবধান ছিলো। কিন্তু স্যাটেলাইট, প্রযুক্তি ও টেলিফিল্ম এসবের অগ্রগতির কারণে চলচ্চিত্রশিল্প গ্রাম ও শহর উভয় ক্ষেত্রেই দর্শকের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। গ্রামগুলো এখন আর আগের সেই গ্রাম নেই। সম্ভবত, ওটিটি আসার পরে মানুষ আমাদের আরো ভালোভাবে চিনতে পেরেছে। এবং এখন আমরা মানুষের কাছে আগের থেকে অনেক বেশি গ্রহণীয়। আশা করি, ভবিষ্যতে এই ব্যাপারগুলো আরো ভালো হবে। 


অনুবাদক : সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন ম্যাজিক লণ্ঠনের সহকারী সম্পাদক রীতা জান্নাত।


এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন