আসিফ রহমান সৈকত
প্রকাশিত ২১ মে ২০২৪ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
‘হীরামান্ডি’ : দেশের স্বাধীনতা আর ব্যক্তির স্বাধীনতার গল্প
আসিফ রহমান সৈকত
‘আমরা দেখতে চাই, স্বাধীনতাকে।
আমরা স্বাধীনতাকে দেখতে চাই ।’
এই একটা গানে পুরো ‘হীরামান্ডি’র, পুরো আট পর্বের প্রাণ লুকানো আছে। এই আট পর্ব যেনো এই গানের জন্য, নিজেদেরকে তৈরি করতে করতে, গল্পের পরিণতির দিকে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। নেটফ্লিক্স গানটির ইংরেজি অনুবাদ করেছে এভাবে, We want freedom; হয়তো হতে পারতো, We want to see, The Freedom. অর্থাৎ ‘স্বাধীনতার চেহারা কেমন দেখতে চাই’, সেই আকুতি, সেই দাবি ছিলো এই গানে। এই স্বাধীনতা দেশের। এই স্বাধীনতা ব্যক্তির। এই দুইটা বিষয়কে এক বিন্দুতে নিয়ে আসে ‘হীরামান্ডি’, আর এই গান তার সেরা প্রকাশ।
ভারতের কবি আস মোহাম্মদ তুরাজের কথায় এবং সঞ্জয় লীলা বানসালির সঙ্গীতায়োজনে এই গান যদি ১৯৪৭-এর আগে হতো আমার পুরো বিশ্বাস এটা সেরা একটা দেশাত্মবোধক গান হিসেবে মানুষের মুখে মুখে থাকতো; এই গান হতো মিছিলে, সভায়, প্রতিবাদে, উদযাপনে। যেনো পুরো ‘হীরামান্ডি’র কাহিনির দাবি এই গানে। পুরো জাতির আকুতি। ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনের, শোষণের, দমন-নিপীড়ন-লুট-অপমান আর যন্ত্রণার বিপরীতে জোরালো প্রতিবাদ; যেখানে আকুতি আছে মুক্তির, আছে ক্রোধ, আছে কান্না আর আছে স্বাধীনতার স্বপ্ন।
২.
সঞ্জয় লীলা বানসালি এমন একজন পরিচালক যিনি নিজেই সঙ্গীত এবং চলচ্চিত্র পরিচালনায় দক্ষ। হিন্দি চলচ্চিত্রের জগতে এই জায়গায় তিনি আলাদা। গভীর শিল্পবোধ সম্পন্ন একজন চলচ্চিত্র-শিল্পী। চলচ্চিত্রশিল্পকে তিনি এমনভাবে দেখেন, যেখানে তিনি শিল্পের সব শাখাকে এক জায়গাতে নিয়ে আসার এবং প্রতিটি ক্ষেত্রকে পরিশীলিত করে সামনে পরিবেশন করেন। তিনি সবসময় যে ধরনের কাজ করে এসেছেন, তার ধারাবাহিকতায় দীর্ঘদিন ধরে যে শক্তি সঞ্চয় করেছেন , সেটার সব থেকে শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ মনে হয়েছে ‘হীরামান্ডি’ টিভি সিরিজ। টিভি সিরিজ হলেও চলচ্চিত্রিক জায়গা থেকেই এই নির্মাণ। অনেক দৃশ্যই দেখে আপনার মনে হবে বড়ো পর্দায় দেখতে পারলে ব্যাপারটা আরো জোরালো এবং বোধের চূড়ান্ত পর্যায়কে ছুঁয়ে যেতে পারতো। চলচ্চিত্রের মতো করেই নির্মাণ করা। চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়নের যে রূপ সেটাই পাওয়া যায় ‘হীরামান্ডি’তে। হলিউডে মিউজিকাল জনরার যে চলচ্চিত্রগুলো দেখা যায়, যেমন সাম্প্রতিক সময়ের ‘লা লা ল্যান্ড’ (২০১৬) বা ‘দ্যা ওয়েস্ট ল্যান্ড’ (২০২১) সেগুলো নিয়মিত নির্মিত হয় না। হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে বা ভারতের ফিল্মের জগতের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ব্যাপারটা উল্টো, সেখানে এই মিউজিকাল ঘরানার চলচ্চিত্রই অনেকটা প্রধান ধারা। চলচ্চিত্র মুক্তির আগেই এখানে তার গানের সিডি বের হয়; সেই একই ব্যাপারটা এখন ঘটে ইউটিউবে ওই প্রোডাকশন হাউজের চ্যানেলে অথবা পরিচালকের চ্যানেলে বা চলচ্চিত্রের জন্য নতুন করে খোলা কোনো ফেসবুক পেজে অথবা ইন্সটাগ্রামে। চলচ্চিত্রের আগেই সেখানে চলে আসে তার গান যা দর্শককে চলচ্চিত্রটি দেখতে আহ্বান করে। এই অঞ্চলের দর্শকের এটা অনেক দিনের অভ্যাস বা এভাবেই অভ্যাসটা করানো হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এই গানের বিষয়টা চলচ্চিত্রের গল্প বা কাহিনির সাথে খুবই অপ্রাসঙ্গিকভাবে আসে। সঞ্জয় লীলা বানসালির চলচ্চিত্রে সঙ্গীত শক্তিশালী একটা হাতিয়ার এবং ‘হীরামান্ডি’তে সেটা অপরিহার্যভাবেই এসেছে তোয়ায়িফ বা শিল্পীদের নাচে, গানে , অভিনয়ে।
তোয়ায়িফরা শিল্পী, তাদের একটা সমাজ আছে আর তাদেরকে ঘিরে আছে একটা বলয়; নবাবদের আর ক্ষমতাশালীদের বলয়। এই তোয়ায়িফদের রুহকে পর্দায় বানসালি মুন্সিয়ানা দিয়ে হাজির করেছেন।
এটা ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা যুদ্ধের একেবারে অন্যরকম গল্প। সঙ্গীতকে বাদ দিয়ে এই চলচ্চিত্র হয় না (শুধু টিভি সিরিজ থেকেও বেশি কিছু হিসেবেই বলছি)। ক্যামেরার কাজ, মুভমেন্ট, সেগুলো নিয়ে আরো বিস্তর লেখার সুযোগ আছে। একটা বড়ো পর্দার চলচ্চিত্রের সব উপাদান শক্তিশালীভাবেই এই কাজটার মধ্যে আছে। বিশাল সেট, একটা অন্য সময়কে পুরোপুরি তুলে আনা, পোশাক এবং সাজানোর ক্ষেত্রে একটা ব্যাপক আয়োজন, সময় এবং তোয়ায়িফদের উপযোগী করে লেখা গান, সুর, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, অভিনয়, সংলাপ যেনো কবিতা। প্রায় দুই বছর ধরে করা একটা কাজ।
৩.
আমি প্রায়ই দেখি, হিন্দি চলচ্চিত্রে ইদানীং ইংরেজদেরকে এমনভাবে দেখানো হয় যেনো তারা শুধুই ব্রিটিশ সরকারের কর্মচারী। আর তারা শুধুই দায়িত্ব পালন করছে। তারা যে শোষণ করছে, অন্যায়ভাবে বিদেশী হিসেবে এই ভূখণ্ডে লুটপাট করেছে; ভুয়া কাগজপত্র, আইন-আদালত, পুলিশ দিয়ে একটা ভয়ের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিলো, এই ব্যাপারগুলো ইদানীং চলচ্চিত্রে সেভাবে দেখানো হয় না। ‘লাগান’ দেখে মনে হয়েছিলো যেনো অতিরিক্ত ট্যাক্স নেওয়াই ইংরেজদের একমাত্র অপরাধ। নবাবরা আর রাজারা আর জমিদাররা যেনো ফেরেশতা, তারা ইংরেজদের কারণেই বাধ্য হয়েছে প্রজাদের ওপর অন্যায় করতে। এগুলো থেকে বানসালি সাহেব বের হয়ে এসেছেন। তিনি নবাব/রাজা/জমিদারদের আসল রূপটা যথেষ্ট ভালোভাবে সামনে নিয়ে এসেছেন। বানসালি ‘হীরামান্ডি’ নামের ইতিহাসভিত্তিক টিভি সিরিজে বিভিন্ন ঘটনা এবং সেই সম্পর্কিত সংলাপ আর দৃশ্যে ইংরেজ শাসকদের শাসনের নামে শোষণের চিত্র ডিটেইলে তুলে ধরেছেন।
ইংরেজদের লাঠিচার্জ দেখা যায়, কিন্তু দেখা যায় না তাদের নিয়মিত ১৪৪ ধারা জারি আর সে সময় যখন তখন ইলেক্ট্রিসিটি বন্ধ করে দেওয়া। ইংরেজদের অত্যাচার দেখা কিন্তু তারা যে কাগজপত্রের মাধ্যমে নবাব থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাইকে নিঃস্ব করে দেওয়া হয়, তা খুব একটা আসে না। তারা যে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দুর্ভিক্ষ দিয়ে লাখ লাখ বাঙালিকে মেরে ফেলতে পারে, সেটাও পর্দায় দেখা যায় না বললেই চলে। শুধু দেখা যায় দুর্ভিক্ষ হয়েছে আর বাঙালি মরে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা যে ইংরেজদের চাল, তাদের অবদান, তৎকালীন ভারতীয়দের ওপর তাদের নির্মম প্রতিশোধ, সেটা টিভিতে বা চলচ্চিত্রে জোরালোভাবে দেখা যায় না।
ইংরেজরা নিজেদের দেশ ইংল্যান্ড বা ওই অঞ্চলের মতো সিস্টেম এই ভারতীয় উপমহাদেশে চালু করেছিলো ঠিকই, কিন্তু সেটাকে এই দেশের মানুষের ওপর অপব্যবহার করার জন্য। সেটা ইংরেজদের সিস্টেম হতে পারে, কিন্তু সেটা উপনিবেশ চালানোর সিস্টেম, কলোনিয়াল সিস্টেম, এটা স্বাভাবিক দেশ চালানোর সিস্টেম না। সেটা শোষণের জন্য বানানো সিস্টেম; লুটের জন্য, চুরির জন্য, দমন করে রাখার সিস্টেম। এই যুগেও অনেকেই ইংরেজদের অনেক কিছুর উদাহরণ দিয়ে সেটাকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করে, কিন্তু ভুলে যায় সেইসব কথা। ভুলে যায় তারা শাসক নয়, ছিলো শোষক। ঐ সিস্টেমকে তারা নিজের দেশে সেভাবে ব্যবহার করতো না, বা করতে পারতো না বা তার দেশের স্বাধীন মানুষের সাথে সেটা তারা করতে পারতো না। প্রায়ই দেখা যায়, বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে নিয়মিত ইতিহাস চর্চায় ইংরেজদের নথিপত্রকে অনেক সময় রেফারেন্স হিসেবে আনা হয় এবং সেটা যে আরেকটা বড়ো জোচ্চুরি বা অধিকাংশ সময় সেই সব নথিপত্র যে শুধুই শাসন করার স্বার্থে মিথ্যা, বানোয়াট কাগজপত্র, যা ইংরেজদের নিজেদের রক্ষা করার, ইতিহাসে নিজেদেরকে মহিমান্বিত করার, নিজেদের চুরি ও অন্যায়কে ধামাচাপা দেয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়, সেই সত্য কথাটা ‘হীরামান্ডি’তে বলা হয় বার বার। ‘হীরামান্ডি’ সেটাকে সামনে নিয়ে এসেছে। তাদের নথিপত্রগুলো যে পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য নয়, সেগুলোকে ধ্রুব সত্য ধরে যারা গবেষণা করে বা ইংরেজদের প্রশংসার চেষ্টা করে, সেই ব্যাপারটা যে আরেক ধরনের দালালি, ইংরেজের দালালির উপায় এবং উপমহাদেশের মানুষের কলোনিয়াল মানসিকতায় এখনো ডুবে থাকার প্রকাশ, সেইটা এখন বোঝা যায়। ’হীরামান্ডি’ সেই কথাগুলো বলে। বিভিন্ন বিল্পবী বা মতবিরোধীদের দমনে ইংরেজরা দারুণভাবে সেইসময়ে প্রচলিত সংবাদপত্রে নিজের মতো করে খবর ছাপাতো এবং নথিপত্র ব্যবহার করতো। যে ইন্সপেক্টর অন্যায় করতো সে নিজেই নিজের ইচ্ছেমতো রিপোর্ট লিখে সেটা সংবাদে প্রকাশ করে অন্য আরেকটা গল্প ফাঁদতো। আর ভারতীয়দের নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাসের বীজ বুনতো। এভাবে দেখলে ১৯০-২০০ বছরে ইংরেজদের অপকর্ম এই ভারতীয় উপমহাদেশে আমরা যা ভাবছি তার থেকে শতগুণ বেশি হবার কথা। আপনি কি মনে করেন, ভারতকে সমৃদ্ধ করতে, ভারতে রেললাইন স্থাপন করতে, আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার করতে, কাটা চামচ দিয়ে খাবার খাওয়া শেখাতে, তাদের তথাকথিত সভ্যতা শেখাতে হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ইংরেজরা এই দেশে এসেছিলো? এইসব কথা যারা বলেন তারা ইংরেজদের বড়ো দালাল, যারা এখনো দালালি করেন। এবং চোরদের মতোই এই দেশের সম্পদ চুরি করে বিদেশে পাচার করেন। তাদের রক্তে এখনো ইংরেজদের দালালদের রক্ত। বানসালি এই ব্যাপারটা দারুণভাবে দেখিয়েছেন। যেহেতু ইংরেজরা লাহোরে তাদের শাসনের সুবিধার্থেই নবাবদের ব্যবহার করতো বা নবাবরা তাদের সাথে থাকতো (যদিও ইংরেজরা নবাবদের নিজেদের গোলামই ভাবতো এবং প্রকাশ্যে নবাবদের সামনে সেটা বলতো না যাতে নবাবরা পক্ষে থাকে), তাই ইংরেজদের কারণে নবাবদের স্বার্থে কোনো আঘাত লাগলে বা ইংরেজরা ভুল করে কোনো নবাবের ক্ষতি করে ফেললে সেই ক্ষেত্রে ইংরেজরা কীভাবে বানোয়াট খবর প্রচার করতো নিজেদের সংবাদপত্র, জেলের সরকারি নথিপত্র আর ভয়-ভীতি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে, তার একটা ভালো চলচ্চিত্রায়ন দেখা যায় ‘হীরামান্ডি’র শেষ দুই পর্বে।
কারো যদি পুরো সিরিজ দেখার সময় না থাকে তাহলে শেষ দুই অথবা তিন পর্ব দেখলেও একটা নির্যাস পাবেন পুরো সিরিজের। হয়তো সেই কারণে পুরো ৮ পর্ব দেখার আগ্রহও জন্মাতে পারে। তার ওপর বানসালির সুন্দর সঙ্গীত আর তার কবিতার মতো কথা (লিরিক), কবিতার মতো সংলাপ, সব কিছু আপনাকে শিল্পের একটা শক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে, যেখানে আছে প্রেম, দ্রোহ, ক্রোধ, ভয়, বীর রস, হাস্যরসের অনুভূতির সাথে ইতিহাসের সেই সময়ে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার অনুভূতি, যা ঘটনার উপলব্ধিকে সহজ করে।
৪.
একটা সময়কে, অতীতের একটা সময়কে, গভীরভাবে উপলব্ধির জন্য সেই সময়ের সাধারণ মানুষের বয়ান সব থেকে বেশি উপযোগী। প্রতিদিনের সাধারণ ঘটনা একটা সময়ের অবস্থার অনুধাবনে সাহায্য করে। মানুষ সময়টা উপলব্ধি করতে পারে। ইতিহাস বা তোয়ারিখ বা হিস্টরি যাই বলেন না কেনো, সেটার একটা বড়ো কঠিন ব্যাপার হলো সাধারণ মানুষের কাছে সেই সময়ের কথা বলার সময় সেটা প্রায়ই হয়ে যায় রাজা বাদশার গল্প, নইলে কোনো ধনী-মধ্যবিত্তেরই গল্প। কিন্তু সব স্তরের মানুষের গল্প, তখনকার বাজার, রাস্তাঘাট, দালান, রাতের বাতি এগুলো না বুঝতে পারলে, চলচ্চিত্রে সেগুলো না দেখতে পারলে, সেই সময়ের সাথে নিজেকে যুক্ত করা , সেই কনটেক্সটে গল্পটাকে উপলব্ধি করাটা একটু কঠিন হয়ে যায়। তাই ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে সেই সময়ের সেট, পোশাক, গাড়ি, যানবাহন, ভাষা, রাস্তাঘাট, দালান সব কিছুকে সামনে আনা জরুরী। এখন অবশ্য একটা ভালো ব্যাপার হলো পুরো জিনিসটা চাইলে অ্যানিমেশনে করা যায়, কিন্তু দিন শেষে আপনার বিস্তারিত এবং ব্যাপক গবেষণার কোনো বিকল্প নাই। যেটা প্রচুর সময় এবং পরিশ্রম দাবি করে। অভিজ্ঞ শিক্ষক বা ইতিহাসবিদের সহায়তা দাবি করে। কারণ এই জায়গাটাতে ফাঁক থাকলে, পরে আপনি অ্যানিমেশন, নায়ক-নায়িকা, সঙ্গীতে যতো পয়সাই খরচ করেন না কেনো, ফাঁক থেকেই যাবে। গবেষণা তথা প্রি-প্রোডাকশনের গুরুত্ব কতো বেশি, সেই ব্যাপারগুলো হয়তো আপনাকে সেটা অনুধাবন করতে সাহায্য করবে। বানসালির ‘হীরামান্ডি’ এই জায়গাতে যথেষ্ট ডিটেইল এবং সময়কে ধরার ব্যাপারে খুবই মনোযোগী, যা টিভি সিরিজটার মাধ্যমে দর্শককে সেই সময়ে নিয়ে ফেলে, যেখানে আমাদের ইতিহাসের আধারে নির্মিত কাজটাকে বা গল্পটাকে, সেই সময়ের চরিত্রগুলোকে সেই সময়ের মধ্য দিয়ে হৃদয়ঙ্গম করতে সহজ হয় বা হৃদয়কে স্পর্শ করে।
৫.
অনেকে ‘হীরামান্ডি’ ঠিকই দেখবে এবং ইচ্ছে করে হয়তো রেটিংয়ে খারাপ নম্বরও দিয়ে আসবে। কারণটা রাজনৈতিক। রাজনীতিতে ঘৃণার চাষ; ১৯৪৭-এর আগে ভারতীয় বলতে কি বুঝায় সেটা না বুঝতে চাওয়ার ইচ্ছা বা ভুলভাবে সেটা সবাইকে বুঝানোর ইচ্ছা।
আই এম ডি বি বা রোটেন টোমাটোর রেটিং দিয়ে এই সিরিজের গুরুত্ব বা ভালো খারাপ বুঝার সম্ভাবনা কম। (টিভি সিরিজ হলেও ‘হীরামান্ডি’ কাজটা চলচ্চিত্রিক জায়গা থেকেই বানানো; যে প্রয়াস দেখা গেছে ‘দ্যা গেম অফ থোরন’সসহ অনেকগুলো টিভি সিরিজে। আমরা কি খেয়াল করছি যে, ইদানিং ওটিটিতে অভিনয়শিল্পীদের অনেকে ফিরে আসছেন আর কাজের আগ্রহ প্রকাশ করছেন বা ওটিটি সেই সুযোগটা তৈরি করছে, দর্শকের আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতেই।) রেটিংয়ে সত্যিকারের প্রতিফলন এই টিভি সিরিজের ক্ষেত্রে কঠিন, কারণটা রাজনৈতিক এবং ধর্মীয়। একে তো এটা লাহোরের গল্প; দুই, এটা ‘হীরামান্ডি’র গল্প; তিন, এখানে প্রচুর ফার্সি শব্দ যা অনেকের পক্ষেই বুঝা সম্ভব না, আর ইংরেজি দিয়ে অনেকেই এটা বুঝতে চাইবেন না বা বুঝতে পারবেন না। ইংরেজি সাবটাইটেলেও দেখছি বক্তব্য মূল কথা থেকে একটু দূরেই থাকছে। অনেকেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিপ্লব, মুক্তিযুদ্ধের কথা ভুলে গেছেন বা ইংরেজদের কারণেই এই উপমহাদেশে চিরস্থায়ীভাবে এতো এতো সমস্যা তৈরি হয়েছে যে, তার ওপর নিজেদের মারামারিতে আমরা এতো ব্যস্ত যে ইংরেজরা যে আমাদেরকে একটা গরীব রাষ্ট্রে পরিণত করে গেছে, আমাদের সম্পদ চোর-ডাকাতের মতো লুট করে নিয়ে গেছে, সেটা আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। ভারত যতোটা ভুলে গেছে তার থেকে বেশি ভুলে গেছে পাকিস্তান। আর বাংলাদেশ তো ভুলেই গেছে।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের যে লড়াই, যে প্রতিরোধ আন্দোলন সেগুলো নিয়ে আলাপই যেনো শেষ হয়ে গেছে। যেনো এই বাংলার, বাঙালির সব থেকে বড়ো এই ভূখণ্ডের কোনো ভূমিকাই নাই স্বদেশী আন্দোলনে, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে , যেখানে কিনা বাঙালি হিসেবে আমরা ছিলাম প্রথম সারির আন্দোলনের লোক। প্রীতিলতা, নজরুল, সূর্য সেনকেও আমরা ভুলে যেতে বসেছি। ব্রিটিশ আন্দোলনে শত শত বিপ্লবীর ভূমিকা আমরা ভুলে যেতে বসেছি অথবা ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে অথবা ভুলতে বাধ্য হচ্ছি; আন্তর্জাতিক আগ্রাসনে আর নিজেদের বোকামিতে।
এই কারণেই বানসালি এবং উনার টিমকে একটা বিশেষ ধন্যবাদ দিতে হয়। এই দলটা এই উপমহাদেশের সবাইকে আবারো জোরালোভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়, ব্রিটিশদের নির্যাতন, লুটপাটের কথা। নেটফ্লিক্সের কারণে সেটা এখন আরো ভালোভাবে পুরো দুনিয়া জানবে। যারা ভুলে যেতে চায় বা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে, তাদেরকে আবারো নতুন করে, শক্তিশালীভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে এই ‘হীরামান্ডি’।
১ম পর্বের শুরুতেই, আমরা যে লেখাটি দেখি সেটা হলো, ১৯২০ সালের লাহোর, যেটা তখন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ শহর। তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ভারতে ধীরে ধীরে চোখ রাঙ্গানো শুরু করে দিয়েছে। লাহোরে, ব্রিটিশ রাজ, সেইখানকার সামন্তবাদী নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতা ভোগ করছে। ঐদিকে নবাবরা হীরামান্ডির শিল্পীদের কবিতা, গান , নাচ এবং প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করছে। এই পটভূমিতে ঐতিহাসিক এই টিভি সিরিজের গল্পের শুরু।
৬.
‘হীরামান্ডি’ টিভি সিরিজটাতে অনেক ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে বিতর্কের সুযোগ আছে। যদিও দিন শেষে এটা শুধুই একটা টিভি সিরিজ কিন্তু লাহোরে কি হচ্ছিলো ১৯২০-এ, হীরামান্ডিতে কি হচ্ছে, বালুচ বা বেলুচিস্তানের মানুষজন আসলে লাহোরে সেইভাবে ছিলো কিনা বা তারা কি ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য লড়াই করেছে নাকি শুধু বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা চেয়েছে ইত্যাদি শত শত প্রশ্ন তৈরি করে ‘হীরামান্ডি’। সেগুলো নিয়ে আলাপ বা প্রশ্ন বা চিন্তা অথবা বিতর্কের সূত্রপাত ইতোমধ্যেই করে ফেলেছে ‘হীরামান্ডি’। আজাদী বা স্বাধীনতা চেয়েছে মানুষ, কিন্তু কার, কোন অংশের, কোন জাতির এটা নিয়ে একটা মতবিরোধ, বিতর্ক চলছে এই ‘হীরামান্ডি’তে। ‘হীরামান্ডি’র কাজটাকে অরাজনৈতিক বলার কোনো সুযোগ নাই। ফিকশন বলে এর রাজনীতিকে অস্বীকারের কোনো উপায় নাই। ভাষার ব্যবহারে হিন্দি শব্দই বেশি ছিলো, ফার্সি শব্দও এসেছে, কিন্তু লাহোরে যে ভাষায় কথা বলা হতো সেইটা নিয়ে অনেকের দ্বিমত আছে। আরো ভালো বুঝবেন যারা লাহোরের ভাষাটা জানেন। আর অনেকেই বিরক্ত হবেন বিশেষ করে যারা শুধুই বিনোদনের জন্য, সময় কাটানোর জন্য ‘হীরামান্ডি’ দেখবেন। ‘হীরামান্ডি’ শুধু সময় কাটানোর জন্য বানানো কোনো কাজ না। এটা আমি নিশ্চিত। প্রায় দুই বছর ধরে কাজ চলেছে। আটটা পর্ব। ব্যাপক আয়োজন। বিস্তর গবেষণা। সেট ডিজাইন বিশাল। একেবারে সময়টাকে তুলে পর্দায় নিয়ে আসা হয়েছে। শুধু পোশাক কি রকম হবে, অভিনয়শিল্পীদের পোশাক, চুলের স্টাইল, অলংকার এগুলোর জন্যই তো দিনের পর দিন সময় চলে যাওয়ার কথা; এক একটা শটের জন্য তাদের তৈরি হতেই তো দিন চলে যাওয়ার কথা। পোশাকের এই বর্ণিল ব্যপারটা তো এই উপমহাদেশের মতো পৃথিবীর আর কোথাও এতো ব্যাপক না।
তোয়ায়িফ শিল্পীদের পোশাক তাও একেক অনুষ্ঠানে, একেক সময়ে একেক রকম। নবাবদের পোশাক. সাথে তাদের মাহফিলে যেসব নারী-পুরুষ উপস্থিত থাকতেন, তাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে যারা উপস্থিত থাকতেন, তাদের পোশাক, আয়োজন, সেট ডিজাইন; অভিজ্ঞ এবং সেই সময়ের জ্ঞান না থাকলে, এই কাজ অসম্ভব। এবং বলতে গেলে এই বিশাল ব্যাপারটা পুরো আয়োজনের একটা অংশমাত্র, যার বাজেটে হয়তো অনেকে একটা পুরো চলচ্চিত্র তৈরি করে ফেলতে পারবে। পুরো ‘হীরামান্ডি’র বাজেট ২০০ কোটি রুপী ( ২৬০ কোটি টাকার উপর, ২০২৪-এর হিসাবে)। বানসালি সাহেব নিয়েছেন ৫০-৬০ কোটি রুপী, অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে সোনাকসি সিনহা ২ কোটি, মনীষা কৈরালা ১ কোটি, অদিতি রাও হায়দারি দেড় কোটি, সানজিদা শেখ ৪০ লাখ রুপী নিয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায় এর ব্যাপকতা! আটটা পর্ব যদি ধরি, গড়ে এক এক পর্বে বাজেট তাহলে ধরেন , ২৫ কোটি রুপী! আর আমাদের বাংলাদেশে মনে করা হয় একটা ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র বানিয়ে ফেলবো এক-দুই কোটি টাকা দিয়ে। চলচ্চিত্রে ৬০-৭০ লাখ টাকা বাজেট দিলে অনেকেই মনে করি অনেক টাকা দিয়ে ফেলেছে। যে কারণে সেটাতে পরে অন্য প্রযোজককেও নিয়ে আসতে হয়।
‘হীরামান্ডি’ ব্যাপক একটা কাজ। এটা নিয়ে কথা বলতে গেলে দেখতে হবে; তারপর কথা বলতে হবে। পক্ষে বা বিপক্ষে , সমস্যা নেই। কিন্তু দেখাটা জরুরী মনে করি।
৭.
হীরামান্ডি শব্দটা একটা জায়গার নাম । হীরা মান্ডি। হীরা বা ডায়মন্ডের বাজার। বর্তমান পাকিস্তানের ওয়ালেড শহরে অবস্থিত। প্রথমে নাম ছিলো হীরা সিং ডি মান্ডি। মানে হীরা সিং এর বাজার যেখানে শস্য বেচাকেনা হতো। বিখ্যাত তাকসালী দারওয়াজা এবং মোগল আমলের বাদশাহী মসজিদ সেখানেই অবস্থিত। নৃত্য এবং গীতের সাথে সম্পর্কিত একটা বড়ো কমিউনিটি সেখানে বসবাস করতো, যারা তাওয়ায়িফ সংস্কৃতিকে লালন করতো। অস্ত্র আর গায়ের জোরে, ব্রিটিশদের ভারতীয় উপমহাদেশ দখলের পর এই তাওয়ায়িফ, নাচ-গানের সাংস্কৃতিক বলয়কে তারা প্রস্টিটিউশনের দিকে নিয়ে যায় বা বাধ্য করে বা বাধ্য হয়। ব্রিটিশদের এই এলাকার প্রচলিত সাংস্কৃতিক চর্চাকে টিকিয়ে রাখার কোনো ইচ্ছাই ছিলো না। তারা তাদের চিন্তা-ভাবনা আর ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এই সাংস্কৃতিক চর্চাটাকেও নষ্ট বা দূষিত করে দেয়। স্বাধীনতার পর এই তাওয়ায়িফদের অনেকেই লাহোরের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে বিখ্যাত হয়েছেন। ইতিহাসের গভীর পাঠ জরুরী। কারণ ইংরেজ শাসক বা শোষকরা অনেক কিছুর সংজ্ঞা তৈরি করে দেন। যে ইংরেজরা শহরের নাম পরিবর্তন করে দিতে পারে, মানুষের নাম বদলে দিতে পারে, সেই ইংরেজ আরো অনেক কিছুই পরিবর্তন করে দিবে। আর ২০০ বছর মানে তো তিন থেকে চারটা জেনারেশন। যেহেতু তাদের হাতে ছিলো, সংবাদপত্র, বই, আদালত, পুলিশ, তাই তারা সেগুলোর পূর্ণ ব্যবহার করে এই অঞ্চলের অনেক কিছুকেই নিজেদের মতো সংজ্ঞায়িত করেছে। ‘হীরামান্ডি’ আমাদের সেই কথাটাই বলে। ‘হীরামান্ডি’ বলে, দয়া করে ইংরেজরা যা বলে গেছে, মিডিয়াতে যা বলা আছে, বইয়ে বা পত্রিকাতে যা লেখা হয়েছে, মানুষ মুখে মুখে যা ছড়িয়েছে, তার সবকিছু বিশ্বাস করবেন না। যাচাই করে দেখুন, সত্য যেহেতু শক্তিশালী, সেটাকে অবশ্যই খুঁজে পাবেন। মিথ্যার আবর্জনাতে চাপা পড়ে আছে; আর যে সত্য যতো শক্তিশালী তার ওপর মিথ্যার আবর্জনার স্তুপ ততো উঁচু। এজন্যই ‘হীরামান্ডি’ গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের যে প্রচলিত ধারণা আছে হীরামান্ডি বা ইংরেজ বা নবাব/রাজা/জমিদারদের ব্যাপারে সেটাকে ‘হীরামান্ডি’ সজোরে নাড়া দেয়।
তাওয়ায়িফ : طائفة তোয়াইফাতুন/ Twaif
‘হীরামান্ডি’ টিভি সিরিজের কেন্দ্রীয় অধিকাংশ চরিত্রে আছে তাওয়ায়িফরা। আজকের দুনিয়াতে গজলকে উঁচুস্তরের মর্যাদা দেওয়া হয়। পুরো দক্ষিণ এশিয়াতে গজল একটা গুরুত্বপূর্ণ আর্ট-ফর্ম। ২০০ থেকে ৪০০ বছর ধরে যারা এই আর্ট-ফর্মটাকে টিকিয়ে রেখেছে তারা কারা? তারাই তাওয়ায়িফ। সময়ের সাথে যাদেরকে অসম্মানের একটা অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বা ইতিহাস নিয়ে গেছে বা ইংরেজরা নিজেদের স্বার্থেই সেই চেষ্টাটা করেছে। আর সাথে আছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিজস্ব রাজনীতি। যখন ইংরেজরা বুঝতে পেরেছে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে, অসহযোগ আন্দোলনে তাওয়ায়িফদের সংশ্লিষ্টতা আছে, তখন থেকেই এই ষড়যন্ত্রের সূচনা। আর ইংরেজরা যখনই কোনো কিছু নিয়ে ঝামেলায় পড়েছে তখনই তাদেরকে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ দিয়ে শাসন করেছে, অথবা বদনাম করে, সমাজে তাদেরকে ছোটো করেছে, জাতের নাম দিয়েছে, আশরাফ-আতরাফের দেয়াল তুলে দিয়েছে আরো জোরালোভাবে। বাজে কথা ছড়িয়ে সমাজে তাদের অবস্থান খারাপ করতে চেয়েছে আর এভাবেই ধর্মকে পুঁজি করে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে; ইংরেজদের শাসনের এই ছিলো সব থেকে বড়ো হাতিয়ার, আর আমরা এই ব্যাপারগুলো বুঝতে বুঝতেই ইংরেজ শাসনকালকে নিজেরাই আরো দীর্ঘায়িত করেছি, একেবারে অযথা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সব তাওয়ায়িফ, কলাকার বা শিল্পীর নাম পর্যন্ত লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজন মনে করা হয়নি। এর একটা বড়ো কারণ হলো তারা নারী। তাদের সাথে ট্রান্সজেন্ডারদের যোগাযোগ আছে। আরো কারণ আছে যা জোরালোভাবে পুরুষতান্ত্রিক, সাথে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ইস্যু যোগ করেছে নবাবরা, রাজারা। আর ইংরেজরা তো আছেই যারা নবাবদের গোলাম মনে করে, তাদেরকে খান বাহাদুর খেতাব দিয়ে খুশি রাখে। এই লেখাতে খুব বেশি বা বিস্তারিত হয়তো তাওয়ায়িফদের ব্যাপারে আলাপ করা যাবে না, কিন্তু মনে রাখতে হবে তারা ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের নিজেদের মানুষ, যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন; তাদের নিজেদের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাদের উল্লেখযোগ্য অবদান আছে, যেটা বরাবরের মতোই নারী হবার কারণে ইতিহাসে উপেক্ষিত। ‘হীরামান্ডি’ টিভি সিরিজে ভারতীয় উপমহাদেশের (আজকের ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) স্বাধীনতা সংগ্রামে তাওয়ায়িফদের বিপ্লবী ভূমিকাকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। তারা যে নিয়মিত আর্থিক সহায়তা করতো বিপ্লবীদের সেটা বলা হয়েছে। বিপ্লবীরা ব্যাপক সহযোগিতা পেয়েছে তাদের। এই কথাগুলোই আবার স্মরণ করিয়ে দেয় ‘হীরামান্ডি’।
তাওয়ায়িফদের হাতে, শিল্পীদের হাতে সম্পদ ছিলো। সমাজের উঁচু মহলের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও প্রশাসক মহলে তাদের যোগাযোগ ছিলো। সেইসাথে ছিলো ক্ষমতা আর আত্মমর্যাদা। বিদেশী শাসক ইংরেজ এবং নিজের দেশের জমিদার, নবাবদের সাথে তাদের ওঠাবসা ছিলো। নেতৃস্থানীয় সব ঘটনাই তাদের জানার সুযোগ ছিলো।১
সমাজের সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলো তাদের ছেলেদের তাওয়ায়িফদের কাছে পাঠাতো ‘তেহজিব’ বা আদব-কায়দা (ইংরেজিতে এটিকেট) শিখতে আর কথা বলার কলাকৌশল বা শিল্পিত রূপ হিসেবে সেটাকে আয়ত্ত করতে।
তাওয়ায়িফ হিসেবে যে মেয়েদের কথা বলা হয়েছে, তারা অনেক কিছুতেই সাধারণ ভারতীয় নারীদের থেকে আলাদা ছিলো। সাধারণ নারীরা সেইসব চিন্তাও করতে পারতো না। ১৯২০ বা এর আশেপাশের সময়ে তো অবশ্যই (‘হীরামান্ডি’ ১৯২০-এ লাহোরের ঘটনা দেখিয়েছে), তাওয়ায়িফরা শিক্ষিত ছিলো, তাদের নিজস্ব আয় ছিলো। তাদের জীবনযাত্রায় ছিলো আভিজাত্য এবং স্টাইল-গ্ল্যামার যাই বলেন না কেনো। তার ওপর তারা নিয়মিত ট্যাক্স দিতো! তাওয়ায়িফের সাথে সম্পর্ক থাকাটা মোগল আমলে স্ট্যাটাস, সম্পদ, মর্যাদা হিসেবে মনে করা হতো। তাদেরকে যৌনকর্মী হিসেবে অনেকেই দেখানোর চেষ্টা করলেও সেটার ঐতিহাসিক ভিত্তি জোরালো না। তবে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তির তাদের পৃষ্ঠপোষকদের সাথে সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনা ছিলো; কিন্তু সেটা অবশ্য সম্মানের সাথে, আত্মসম্মানবোধকে মূল্য দিয়েই।২
এইরকম-ই একজন হলেন আযিযুন বাঈ, যিনি মূলত লাখনৌর মেয়ে, অল্প বয়সেই কানপুরে চলে আসেন। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর উইমেন্স স্টাডিজের শিক্ষক লতা সিং তার প্রকাশিত গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, আযিযুন বাঈ ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির সিপাহীদের কাছের মানুষ ছিলেন; বিশেষ করে শামসুদ্দিন খানের। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে তার অংশগ্রহণ ছিলো । তার বাসায় সিপাহীরা মিটিং করতো। আযিযুন বাঈ মেয়েদেরকে সাথে নিয়ে একটা দল সংগঠিত করেছিলেন; যারা অস্ত্র হাতে সৈন্যদের উৎসাহ দিতো; তাদের কাছে পিস্তল থাকতো; আহত সিপাহীদের সেবা শুশ্রুষা করতো এবং ভয়ডরহীনভাবে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পৌছে দেবার কাজ করতো।
এই তোয়ায়িফদেরকে ‘নাচের মেয়ে’ বা ‘নচ গার্ল” নাম দিয়েছিলো ব্রিটিশরা এবং তাদের কাজকে প্রস্টিটিউশনের সাথে জড়ানোর কাজটা করেছে ব্রিটিশরা। কারণ সেটা রাজনৈতিকভাবে তাদের জন্য সুবিধাজনক এবং মোগলদের বিরুদ্ধে একধরনের পদক্ষেপ, যেহেতু মোগলদের থেকে তারা শাসনভার নিজেদের হাতে নিয়েছিলো। তাই মোগলদের কোনো কাজকে নোংরা করতে পারলেই তারা নিজেদের সফল মনে করতো। লতা সিং এর মতে, হুসাইনি ছিলেন বিবিঘর (যেখানে ইংরেজদের স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা থাকতো) হত্যাকাণ্ডের প্রধান ষড়যন্ত্রকারী, যেখানে ১০০ এর উপর ব্রিটিশ নারী ও শিশু মারা যায়।
মহাত্মা গান্ধী ১৯২১ সালে গওহর জান নামের একজন বিখ্যাত শিল্পীকে স্বরাজ ফান্ডে অর্থ সাহায্যের জন্য অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য বলেন। গওহর জান তাতে সম্মতি দেন কিন্তু শর্ত দেন যে গান্ধীকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হবে। গান্ধী উপস্থিত হতে পারেননি। গওহর জান তাই যে টাকা উঠেছিলো তার অর্ধেক পাঠিয়েছিলেন ।৩
এইরকম অনেক অনেক উদাহরণ রয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তোয়ায়িফদের শক্তিশালী ভূমিকার কথা সামনে আসছে। ‘হীরামান্ডি’ সেই কথা ভারতবাসীকে আবারো মনে করিয়ে দিলো, যা তাদের অনেকেই ভুলে যেতে বসেছিলো। তোয়ায়িফরা তাদের গানের আসরে দেশাত্মবোধক গান গাওয়া চালু করেছিলো। তোয়ায়িফরা নারী বলেই হয়তো তাদের কথা সেভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়নি কিংবা তাদের নিয়ে একধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিলো বলেই হয়তো তাদের কথা সহজে সামনে আসেনি। ‘হীরামান্ডি’ জোরালোভাবে সেই কাজটাই করেছে। সঞ্জয় লীলা বানসালি তার শিল্পীর মন নিয়ে বিষয়টাকে তুলে ধরেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদানকে কি যথাযথ সম্মান দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে যে নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের ভাত রান্না করে খাইয়েছে; যে নারীরা জীবন বাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে; তাদের এই অবদানকে আমরা কীভাবে দেখি। যারা গান গেয়ে আমাদের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছে জালিমদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে, তাদের আমরা মুক্তিযোদ্ধা কেনো বলি না? এই মানুষগুলো ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পন্ন। তাদের সংখ্যা কি গুরুত্ব দিয়ে মনে রাখা হয়? মুক্তিযোদ্ধারাও কি সেটা মনে রেখেছে? সেই সব নারীদের যথাযথ সম্মান দিয়েছে? তাহলে ভাবুন, ১০০ বছর আগের তোয়ায়িফদের কথা।
তোয়ায়িফরা হলেন শিল্পী। টিভি, রেডিও ছাড়া একটা পৃথিবীর কথা ভাবুন, বুঝতে সহজ হবে। সেখানে কিন্তু মহলে বা আসরেই শিল্প চর্চা হতো। এর সাথে অন্যকিছুকে জড়ানোর মানে হলো ব্যাপারটাকে বিকৃত করা। কারো বা কয়েকজনের ব্যক্তিগত ব্যাপারকে তাদের মূল পেশার সাথে যুক্ত করে শিল্পীকে অপমান করাটা অনেকের আজকের দিনেরও অভ্যাস। একজন ভালো অভিনেতা একটা খারাপ ব্যাপারে জড়ালো, সেটা অভিনেতা হিসেবে সেই মানুষটার ব্যাপার, তার ব্যক্তিগত ইস্যু, এটার জন্য অভিনয় বা নাটক বা চলচ্চিত্রকে যেমন খারাপ কাজ বলা যায় না; তেমনি তোয়ায়িফরা হচ্ছেন শিল্পী, যারা নাচ, গান, শায়েরীতে পারদর্শী। তাদের মধ্যে কারো কারো হয়তো অন্য গল্প আছে, যেটা অনেকের পছন্দ না, কিন্তু মূলত উনারা তো শিল্পী। লাহোরের হীরামান্ডিতে এইরকম একটা তোয়ায়িফ ছিলো । সেখানকার শিল্পীরা কীভাবে সমাজে নবাব এবং ইংরেজদের সাথে জড়িয়ে ছিলো, এবং সেটা পরে কীভাবে আজাদীর আন্দোলনে তাদেরকে সম্পৃক্ত করে, সেই গল্পটা যথেষ্ট মুন্সিয়ানার সঙ্গে পরিচালক বলেছেন। শিল্প এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে দারুণভাবে পর্দায় উপস্থাপন করেছেন তিনি। নির্মাণ শুরু হবার প্রায় দুই বছর পর এটা মুক্তি পেলো ওটিটি প্লাটফর্ম নেটফ্লিক্সে। দেখার পর আপনার মনেই হবে বাজেট কতো, কী পরিমাণ গবেষণা, কীভাবে করলো, আপনি কাজের মধ্যে আলাদা কিছু দেখতে পাবেন, খুঁজে পাবেন।
৮.
‘হীরামান্ডি’ রিলিজ হলো ভারতের ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়। যখন এই উপমহাদেশের অনেক রাজনৈতিক দলই ধর্মীয় রাজনীতি নিয়ে খেলে যাচ্ছে; যখন উপমহাদেশের দেশগুলো রাজনীতি আর নির্বাচনে ব্যস্ত। অন্যদিকে ‘হিরামান্ডি’র গল্পের একটা বিশেষ তাৎপর্য হলো, এখানে স্বাধীনতা সংগ্রামে যাদের অংশগ্রহণ দেখানো হয়েছে তারা অধিকাংশই হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের অথবা শিখ। আর গল্পটা লাহোরের, ১৯২০ সাল থেকে ১৯৪০-এর মধ্যে; অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের; যখন লাহোর পাকিস্তান ছিলো না, লাহোর ছিলো ব্রিটিশ শাসিত ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর।
প্রশ্ন উঠতে পারে ঠিক এইরকম একটা সময়ে কেনো রিলিজ পেলো ‘হিরামান্ডি’। এটা কি ইচ্ছাকৃত? আমার মনে হয়েছে, এটা পরিকল্পিত। কারণ এইরকম সময়ে এটা রিলিজ পেলে এটা নিয়ে আলাপ সব থেকে বেশি হবে, যখন রাজনীতিতে ধর্ম একটা বাড়াবাড়ি রকমের জরুরি বিষয় হয়ে উঠেছে। মুক্তির পর সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে দেখাও যাচ্ছে, কারা কারা এ নিয়ে কথা বলছে, কার কোথায় ঘা লেগেছে, কে কী বলছে। অবশ্য ভারতে এ রাজনীতি নতুন নয়, দর্শক যদি একটু খেয়াল করে তাহলে নিশ্চয় মনে করতে পারবে, স্টার প্লাসে ‘মহাভারত’ কখন থেকে সম্প্রচার হয়েছিলো। সময়টা খেয়াল করা জরুরী।
৯.
সঞ্জয় লীলা বানসালী ‘হীরামান্ডি’ নিয়ে কাজের করার ঘোষণা দিয়েছিলেন ২০২১ সালের এপ্রিলে; যদিও তিনি এটা নিয়ে চিন্তা শুরু করেন আরো ১৪ বছর আগে থেকে। প্রোডাকশনের কাজ শেষ হয়েছিলো ২০২৩-এর জুনে। ২০২৩ সালে নেটফ্লিক্সের সিইও টেড সারানডোসের সাথে আলাপচারিতায় বানসালি তার ‘হীরামান্ডি’ টিভি সিরিজের কাজটাকে উনার জীবনের সব থেকে বড়ো প্রজেক্ট হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বানসালি ‘হীরামান্ডি’ টিভি সিরিজ নির্মাণকে ভারতের তিনটা জরুরী চলচ্চিত্র ‘মাদার ইন্ডিয়া’ (১৯৫৭), ‘মুঘাল-এ-আজম’ (১৯৬০) এবং ‘পাকিজাহ’ (১৯৭২) এর প্রতি তার ব্যক্তিগত সম্মান প্রদর্শন হিসেবে দেখছেন। ‘হিরামান্ডি’তে পোশাক এবং অলংকরণের দায়িত্বে থাকা রিম্পল নারুলা ও হারপ্রীত নারুলা জানান, তারা এখানে যে ধরনের স্টাইল বা পোশাক বা অলংকার, কথা বলার ভঙ্গি ব্যবহার করেছেন সেগুলো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অভিনয়শিল্পী পেশেন্স কুপার, ভারতীয় ও পাকিস্তানি অভিনয়শিল্পী সুরাইয়া, স্মরণলতা, নূর জাহান, শামশেদ বেগম এবং মুখতার বেগম থেকে অনুপ্রাণিত। লিলি সিং-এর সঙ্গে এক আলাপচারিতায় বানসালি বলেন, তিনি বর্তমান সময়ের পাকিস্তানি অভিনয়শিল্পী মাহিরা খান, ফাওয়াদ খান এবং ইমরান আব্বাসহ কয়েকজনকে এই টিভি সিরিজে নিতে চেয়েছিলেন, বিভিন্ন কারণে তা সম্ভব হয়নি।
সেটা করতে পারলে হয়তো আরো বেশি ভালো হতো বিশেষ করে সংলাপের জায়গা থেকে, যেহেতু ভাষাটা লাহোরের এবং ফার্সি মিশ্রিত হিন্দি-উর্দুর প্রাধান্য আছে। অনেক বছর আগে বানসালি আরো একবার এটা শুরুর চিন্তা করেছিলেন, তখন উনার চিন্তায় রেখা, রানী মুখার্জি এবং কারিনা কাপুর ছিলেন।
বানসালি নিজেই ‘হিরামান্ডি’র সঙ্গীত আয়োজন ও পরিকল্পনা করেছেন। আমির খসরুর কথায় গান করিয়েছেন। তিনি ‘ফুল গেন্দওয়া না মারো’ ও ‘নাজারিয়া কি মারি’ এই লোকসঙ্গীত দুটো ব্যবহার করেছেন, যা আগে হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে (বলিউড শব্দটা বলতে চাই না) ‘দুজ কা চান্দ’ (১৯৬৪) এবং ‘পাকিজাহ’য় (১৯৭২) ব্যবহৃত হয়। ভারতের কবি ও গীতিকার আস মুহাম্মাদ তুরাজ - যিনি কিনা বানসালির অন্যান্য চলচ্চিত্রেও গান লিখেছেন - এই টিভি সিরিজেও তার ছয়টি গান আছে। অবশ্যই সুর করেছেন বানসালি এবং তার নিজের বানসালি মিউজিক। ভারতের খুব কম পরিচালকেরই এই দক্ষতা এবং সক্ষমতা আছে।
১০.
আর একটা বিষয় না বললেই নয়, ‘হিরামান্ডি’র মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু টিভি সিরিজ, ওয়েব সিরিজে বাংলা সাবটাইটেল কিংবা বাংলা ডাবিং করােউচিত বলে মনে করছি। ৩৫ কোটি বাংলাভাষী দর্শকের জন্য এটা করা যেতেই পারে। ভারতে নেটফ্লিক্স সক্রিয়, প্রতিষ্ঠান হিসেবেও, তারা কেনো বাংলাকে নেটফ্লিক্সের জরুরী ভাষা হিসেবে যোগ করছে না! এখানে বাইরের রাজনীতি নাকি এই উপমহাদেশের রাজনীতি জড়িত বিষয়টি ভাববার অবকাশ আছে? কারো যদি হিন্দি এবং উর্দু ভাষা সম্পর্কে ধারণা থাকে তাহলে বুঝতে পারবে ‘হীরামান্ডি’র ভাষাটা আসলে উর্দু এবং গল্পটা লাহোরের। যদিও মনে রাখতে হবে হিন্দি আর উর্দু আসলে একই ভাষা। উর্দুতে ফার্সি ভাষার শব্দের প্রাধান্য বেশি, আর হিন্দিতে সংস্কৃত; কিন্তু কাঠামো ও গঠনগত দিক দিয়ে এটা আসলে একই ভাষা। যে কারণে দুইভাষার লোকজনই একে অন্যকে বুঝতে পারে। নামেই দুই ভাষা, আসলে হিন্দি এবং উর্দু একই ভাষা। শুধু লেখার অক্ষর হিন্দির দেবনাগরী আর উর্দুর হলো ফার্সি বা আরবির লিপি। এই বাস্তবতায় এরকম আশা করাই যায়, শীঘ্রই নেটফ্লিক্সে বাংলা ভাষার সাবটাইটেল চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিজ আসবে। এটা এখন সময়ের দাবি।
১১.
‘হীরামান্ডি’র শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, একজন বিপ্লবী তোয়ায়িফের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হচ্ছে এবং তার প্রতিবাদে নারীদের মশাল মিছিল হচ্ছে। ওই বিপ্লবীকে যখন ইংরেজ পুলিশ কর্মকর্তা অত্যাচার করছিলো তথ্য উদঘাটনের জন্য, তখন যে কথোপকথন হয়, তা থেকে পুরো উপমহাদেশের অবস্থা সম্পর্কে একটা সারাংশ মানে বিপ্লবীদের চিন্তার প্রতিফলন পাওয়া যায়। ওই সংলাপগুলো ছিলো কবিতার মতো। তাদের কথোপকথন ছিলো এরকম,
- বলো, তোমার আর সাথীদের নাম কী?
- স্বাধীনতা
- হামিদ মোহসিনের (একজন বিপ্লবী যিনি মারা গেছেন)আসল উদ্দেশ্য কী ছিলো?
- স্বাধীনতা
- তুমি জানো এই বিদ্রোহের কারণে তোমার ভবিষ্যত কি হবে?
- স্বাধীনতা
লেখক : আসিফ রহমান সৈকত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম এবং ফটোগ্রাফি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করে এখন চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখি, প্রশিক্ষণ এবং নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তিনি ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু ভাষা থেকে অনুবাদ করে থাকেন। পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি পরামর্শক হিসেবেও কাজ করছেন। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘সিনেমা অরাজনৈতিক নয়’ ও ‘লিডার্স ইট লাস্ট’ (সিমন সিনেক-এর বইয়ের অনুবাদ)।
saikatfpdu@gmail.com
তথ্যসূত্র
১. প্রান নেভিল, ‘নচ গার্লস অব ইন্ডিয়া : ড্যান্সারস’, সিঙ্গারস, প্লেমেটস।
২. স্ক্রল ডট ইন; ফার্স্ট পয়েন্ট অনলাইন পত্রিকা; চাইলে দেখতে পারেন : https://tinyurl.com/ycwpther
৩. বিক্রম সাম্পাথ-এর বই ‘মাই নেম ইজ গওহর জান’।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন