Magic Lanthon

               

সাজ্জাদ বকুল, আ-আল মামুন, মামুন হুসাইন ও তানভীর শাওন

প্রকাশিত ৩০ জুন ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

‘কামার মূলত স্থাপত্যবিদ্যার সঙ্গে একটু করে পদ্য, সঙ্গীত ও সাহিত্য মিশিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেকেই নির্মাণ করেছেন’

সাজ্জাদ বকুল, আ-আল মামুন, মামুন হুসাইন ও তানভীর শাওন


গত ১৪ অক্টোবর ২০২৩ ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একাডেমিক ভবনের ১৫০ নম্বর কক্ষে ‘নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন-এর সঙ্গে একবেলা’ শিরোনামে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেই অনুষ্ঠানে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ‘ম্যাজিক লণ্ঠন আড্ডা’. ‘ম্যাজিক লণ্ঠন বাতচিত’ (দর্শকের মুখোমুখি নির্মাতা) এর আয়োজন করা হয়। কামারের শুনতে কি পাও চলচ্চিত্রটি প্রদর্শনের পর এ নিয়ে সম্পূরক ‘ম্যাজিক লণ্ঠন আড্ডা’য় অংশ নেয় প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মামুন হুসাইন, শিক্ষক ও গবেষক আ-আল মামুন, চলচ্চিত্র সংগঠক ও অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ বকুল এবং চলচ্চিত্রবিষয়ক লেখক তানভীর শাওন। পুরো এই আড্ডাটি অনুলিখন করে দুই পর্বে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর পাঠকের জন্য হাজির করা হলো।  [সম্পাদক]    

 

প্রথম পর্ব.

ফারজানা তন্বী : দর্শক, এতোক্ষণ আপনারা কামার আহমাদ সাইমনের শুনতে কি পাও দেখলেন। এটা বিশ্বের প্রাচীনতম প্রামাণ্যচিত্র উৎসব জার্মানির ডক-লাইপজিগ-এর উদ্বোধনী চলচ্চিত্র হিসেবে প্রদর্শিত হয়েছিলো। একইসঙ্গে এটা ইউরোপের অন্যতম প্রামাণ্যচিত্র উৎসব ফ্রান্সের সিনেমা দ্যু রিল-এর ৩৫তম আসরে সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘গ্রাঁ প্রি’ জিতে নেয়। মুম্বাই চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘স্বর্ণশঙ্খ’-ও জেতে শুনতে কি পাও। এছাড়া সুইজারল্যান্ডের লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবে এটা ওপেন ডোর্স স্ক্রিনিং বিভাগেও প্রদর্শিত হয়।

দর্শক, একটি কথা খুবই বলতে ইচ্ছে করছে, ‘হককথা’ বলে একটি অনলাইন অনুষ্ঠান করেন শিক্ষক ও গবেষক ফাহমিদুল হক। ‘হককথা’র একটি পর্বে কামার আহমাদ সাইমন এসেছিলেন অতিথি হিসেবে। কামারকে দর্শকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে ফাহমিদুল হক একটি কথা বলেছিলেন, ‘কামারের কাজগুলো বাংলাদেশের আত্মাকে ধারণ করে’। শুনতে কি পাও দেখতে দেখতে এই কথাটি বার বার মনে পড়ছিলো আমার। দর্শকও হয়তো আমার সঙ্গে একমত হবেন। মাঝখানে একটি কথা বলে নেওয়া দরকার। কামারের সঙ্গে ‘হককথা’র আড্ডাটি ‘ম্যাজিক লণ্ঠন প্রকাশন’ থেকে বই আকারে মুদ্রিত হয়েছে ‘বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’ (২০২২) নামে। বইটিতে কামারের সঙ্গে যৌথভাবে লেখক আছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। দর্শক, আর কথা নয়, এখনই আমরা শুরু করবো ‘ম্যাজিক লণ্ঠন আড্ডা’। আয়োজনের এ পর্বে অংশ নেবেন কথাসাহিত্যিক মামুন হুসাইন, অধ্যাপক আ-আল মামুন, অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ বকুল এবং ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ সদস্য ও চলচ্চিত্রবিষয়ক লেখক তানভীর শাওন। আশা রাখছি, আপনারা পুরোটা সময় আমাদের সঙ্গেই থাকবেন। আলোচকদের আহ্বান করছি মঞ্চে এসে আসন গ্রহণের মধ্য দিয়ে আজকের অনুষ্ঠান শুরু করার জন্য। দর্শক আপনাদের জানিয়ে রাখি, ‘ম্যাজিক লণ্ঠন আড্ডা’টি সঞ্চালনা করবেন অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ বকুল। এখন মঞ্চ ছেড়ে দিচ্ছি আলোচকদের কাছে।

সাজ্জাদ বকুল : সবাইকে শুভেচ্ছা। আমরা কিছুক্ষণ আগে শুনতে কি পাও প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি দেখলাম। এই ছবিটি আমাদের উপকূল অঞ্চলের আইলা দুর্যোগ কবলিত একটি গ্রাম নিয়ে। খুলনার সুতারখালী গ্রামের একটি পরিবারকে ঘিরে দুর্যোগ কবলিত মানুষগুলোর আবার নতুন করে জীবন শুরু করা সেই গল্পটি আমরা শুনতে কি পাও-এ দেখতে পেলাম। আজকে আমাদের মধ্যে এই ছবির নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন এবং প্রযোজক সারা আফরীনসহ তাদের টিম উপস্থিত আছে। দর্শক সারিতেই তারা আছে। এই মুহূর্তে আমরা মুক্ত আড্ডা পর্বে প্রবেশ করছি। যেখানে এই ছবিটি ও অন্যান্য নানা বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলবো, শুনবো। আমাদের সঙ্গে আছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ-আল মামুন। যিনি একজন চলচ্চিত্র গবেষক; চলচ্চিত্র নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন। তার পাশে আছেন কথাসাহিত্যিক মামুন হুসাইন। যিনি পেশায় একজন মনোচিকিৎসক; চলচ্চিত্র বিষয়েও তার গভীর পড়াশোনা এবং লেখাও আছে। তানভীর শাওন আছেন ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর পক্ষ থেকে। আমি সাজ্জাদ বকুল ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর পক্ষ থেকে আ-আল মামুন, মামুন হুসাইন ও তানভীর শাওনকে এই আড্ডা পর্বে স্বাগত জানাই।

আমরা যে ছবিটা একটু আগে দেখলাম, সেটাকে আমি বলেছি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে আমরা সাধারণত যা দেখি, এর ভেতরে বাস্তব ঘটনার এক ধরনের পুনরুৎপাদন হয়। এক ধরনের ক্রিয়েটিভ ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়। যদি বলি যে, ডকুমেন্টারি ফিল্ম ইজ অ্যা ক্রিয়েটিভ ফিল্ম অব অ্যাকচুয়াল রিয়েলিটি, এই কথাটি আমরা শুনতে কি পাও-এ খুবই ঘনিষ্ঠভাবে দেখলাম। আর একটি মজার বিষয় হলো প্রামাণ্য চলচ্চিত্র আসলে রিয়েল টাইম রিয়েলিটি। যে মুহূর্তে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেই মুহূর্তে এই ছবির পরিচালক তিনি নিজেই যেহেতু সিনেমাটোগ্রাফার এবং তার টিম সেখানে উপস্থিত থেকে ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করেছেন ক্যামেরার চোখ দিয়ে। এই পরিস্থিতিতে চলচ্চিত্রটি পাঠ করে আমরা ঠিক কী পেলাম সেই বিষয়গুলো নিয়ে মুক্ত আলোচনার মতো একটা আড্ডা এখানে শুরু করতে চাচ্ছি। আমরা আসলে কোনো ফরমাল আলোচনা করতে চাই না। আড্ডা দিতে চাই। হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি একটু সূত্র ধরিয়ে দেবো। শুরু করতে চাই আ-আল মামুন স্যারকে দিয়ে। তিনি শুনতে কি পাও ছবিটিকে কীভাবে পাঠ করলেন; তার পাঠের অভিজ্ঞতা দিয়েই আমরা আজকের আড্ডা পর্বটা শুরু করছি।

আ-আল মামুন : সাজ্জাদ বকুলকে ধন্যবাদ। শুনতে কি পাও টাইটেলের একটা সার্থকতা আছে। মানে সিনেমাটা নিয়ে যদি আমার অনুভবের কথা বলি দেখার পরে দেখা শুরু করা এবং শেষ করা আসলে আমার কথা বলতে আর ইচ্ছে করছিলো না। আমার মনে হচ্ছিলো, আরো ঘণ্টাখানেক চুপ করে বসে থাকি এবং ভাবি। তবে যে দৃশ্যগুলো চোখের উপর দিয়ে গেলো, যে দৃশ্যগুলো চোখের ভেতর দিয়ে মেমোরিতে গেলো, সেগুলো ডাইজেস্ট হয়ে মানে এক ধরনের কাব্যিক অনুভূতি তৈরি হয়।

একটা অসামান্য গ্রাম অ্যাক্সিডেন্টালি আমিও ২০০৮ সালে সুতারখালী গ্রামে গিয়েছিলাম। ওই আশপাশের অনেকগুলো জায়গায় গিয়েছিলাম এবং সুতারখালী গ্রামের কয়েকটা দৃশ্য, ইমেজ, ল্যান্ডস্কেপ, সমুদ্র পাড়ের দৃশ্য, তাদের ভালনারেবিলিটি—ব্যাপারগুলো ২০০৮ সালে আমি খেয়াল করেছিলাম। সেটা ছিলো সিডর-এর ঠিক কয়েক মাস পরে। ওই সময় ভীষণ ক্ষতচিহ্ন চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো এবং নোনাপানি সব জায়গায় ছেয়ে গেছে, কী বিপন্ন এক পরিস্থিতি!

তবে একটা দিক, যেটা পরিচালক মনোযোগে নিয়ে আসেননি এখানে—সিনেমার কারণেই আমি সেটা পরে বুঝতে পারি। সেটা হচ্ছে, নোনাপানির একটা প্রবল দাপট। এবং দীর্ঘকাল নোনাপানির তিক্ততার কারণে যেটা হয়—অভিজ্ঞতার কারণেই বলছি—ওখানে চিংড়ি ঘের ছিলো, যদি বলি সাতক্ষীরা থেকে শুরু করে বাগেরহাট ও একেবারে বরিশাল পর্যন্ত সুন্দরবনের চারপাশ ঘিরে একটা ভয়ানক ডিজাস্টার ঘটে গিয়েছিলো। সেই ব্যাপারটার দিকে কামার আহমাদ সাইমন কিন্তু অতো নজর দেননি। বরং আমাদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে। যেহেতু আমরা ক্যামেরার চোখ দিয়েই দেখছি। ফলে এই যে ডিজাস্টারটা ঘটেছিলো, সেই দিকে উনি আমাদের নজরটা নিয়ে যাননি। কিন্তু অন্য একটা দিকে নজর নিয়ে গেছেন।

সিনেমাটাতে দেখা যাচ্ছে, একটা অসম্ভব শক্তি মানে মানুষের আত্মশক্তি যেটাকে বলে যদি আমরা দেখি যে সুন্দরবনের আশপাশে কারা বাস করে? ওই সুতারখালী গ্রামটা হচ্ছে পুরোপুরি হিন্দু অধ্যুষিত একটা গ্রাম। গ্রামটার সবাই মূলত মণ্ডল থেকে নিচু পর্যায়ের কিছু বর্ণের। একদমই নিম্নবর্গের মানুষ। খুলনা থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত খেয়াল করেন, এই মানুষগুলো ধাক্কা খেতে খেতে প্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন প্রান্তে, যেখানে যখন তখন বাঘে হানা দেয়, যখন তখন নোনাপানি হানা দেয়। এবং সবসময় তাদের মৃত্যু এবং জীবন একইসঙ্গে পার করতে হয়। এই সিনেমায় দেখাচ্ছে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে জীবনের যে শক্তিমত্তার জায়গা, সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষ ও ভালনারেবল মানুষের যে শক্তির জায়গা, সেটা অসামান্যভাবে উঠে এসেছে এখানে।

সিনেমাটা শুরু হচ্ছে একটা বৃষ্টির শব্দ দিয়ে। সিনেমা যখন শেষ হচ্ছে, তখনো ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ। প্রথমে আমার যে মোহটা তৈরি হলো, শেষে গিয়ে ওই মোহটার আরো গভীরে ঢুকে গেলাম আমি। এবং মানুষের ভেতরের যে শক্তির জায়গা, সেটা অনুভব করতে পারলাম। এটা একটা দুর্দান্ত ব্যাপার! এছাড়া আমি যদি ক্যামেরা এবং স্টোরিটেলিং প্যাটার্নের কথা বলি যেটা বলছিলেন সঞ্চালক, প্রামাণ্য—আমি আসলে নিজেও প্রামাণ্য বা ডকুমেন্টারি এবং ফিকশন, এই বাইনারি গল্পের মধ্যে থাকি না। কারণ ফিকশন এবং ডকুমেন্টারির মধ্যে রিয়েলি কোনো ফাঁরাক নাই। একটা রিয়েলিটির মধ্যে যতো রকমের ফিকশনাল এলিমেন্ট থাকে, আমার ভাষাই কতো রকমের ফিকশনাল রিয়েলিটি হয়ে উঠতে পারে, সেই ব্যাপারগুলো এখানে উঠে এসেছে।

কথা হলো যে, একজন পরিচালক সেই রিয়েলিটিকে—আমরা যতোই ফিকশন বলি না কেনো—কীভাবে রচনা করছেন, কীভাবে গল্পটাকে উপস্থাপন করবেন। এখানে অনেক উপাদান আছে, ক্যামেরার কাজ আছে, ন্যারেটিভ আছে, ক্যারেক্টার চুজ করার ব্যাপার আছে। সেই গল্পের ভেতর থেকে বাছাই করে গল্পকে একটা জায়গায় নিয়ে আসার ব্যাপার আছে। এবং সেখানে আমার কাছে মনে হয় যে, এটা সত্যিকার অর্থে একটা অসামান্য কাজ হয়েছে। এটুকুই আপাতত। এরপরে যদি আবার কথা বলার সুযোগ থাকে তাহলে সেটা পরে বলা যাবে। আরো অনেক কথা আছে। মানে কথার শেষ নেই। কিন্তু আমি এখানেই শেষ করছি। কারণ আরো অনেকেই আছে। সবাই মিলে যদি আলাপ করি, তাহলে সেটা আরো ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠবে।

সাজ্জাদ বকুল : ধন্যবাদ মামুন ভাইকে। আপনার কথা আবার পরে শুনবো আমরা। এই ছবিটিতে আমরা দেখলাম, দুর্যোগ কবলিত এক গ্রামের ঘটনা এবং সেই দুর্যোগ থেকে মানুষের ফিরে আসার চেষ্টা। পরিচালক খুবই সুচিন্তিতভাবে একটা পরিবারকে বেছে নিয়েছেন। রাখি ও সৌমেনের পরিবার। তাদের একটা ছোট্টো বাচ্চা আছে, রাহুল। বেড়িবাঁধের উপরে তাদের যে অস্থায়ী বসবাস, সেই বসবাসের মধ্যেই অতীতে তাদের সুন্দর জীবন ছিলো, পরিবার ছিলো, বাড়ি ছিলো। এই যে তাদের হাহাকার এবং নতুনভাবে তারা বাড়ি করবে সেই আশা, স্বপ্ন, সব মিলেমিশে দেখা গিয়েছে যে বার বার আমরা ব্যাকগ্রাউন্ডে ওই দুর্যোগটাকে ফিরে পাচ্ছি। বাঁধ নির্মাণের যে প্রচেষ্টা, আমাদের যেটা হয়, সরকারি কাজ খুব স্লো গতিতে চলে। যথারীতি ওই বাঁধের কারণেই এদের ঘর প্লাবিত হয়েছে। এই কারণে তারা নিজেরাই বাঁধটা মেরামতের চেষ্টা করে। এখানে এই সাধারণ মানুষের যে লড়াই বা তাদের কথা আসলে উচ্চস্তর পর্যন্ত তারা পৌঁছে দিতে পারছে না। তারা চা স্টলে বসেই তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করছে। শেষ পর্যন্ত তারা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। এবং এর মাধ্যমে পরিচালক একটা ইতিবাচকতার দিকে আমাদের নজরটা মনোনিবেশের চেষ্টা করেন।

আমার মনে হয়, এই ধরনের ছবি নির্মাণ বা চিত্রায়ণ করা খুবই পরিশ্রমের কাজ। আমরা এখানে ছবিটা দেখাতে গিয়েও কতোরকম সমস্যার মধ্যে পড়ি। আর একটা কথা যদি বলি, ও রকম একটা দুর্যোগ কবলিত এলাকায় আমি যতোটা জানি প্রায় তিন বছর ধরে সেখানে গিয়ে শুটিং করতে হয়েছে পুরো টিম নিয়ে সেখানে যাওয়াও একটা দুরূহ ব্যাপার।

কামার ভাই একটু আগে বলছিলেন, চালনা পর্যন্ত গাড়িতে করে, তার পর সেখান থেকে দুই-তিন ঘণ্টা ট্রলারে করে যাওয়া। সেখানে থাকার ভালো পরিবেশ নেই, খাবার পানি নেই এবং এটা দিনের পর দিন চলতেই থাকে। এবং আমরা যে ঘটনাগুলো সিনেমায় দেখতে পাচ্ছিলাম, সেই ঘটনাগুলো কিন্তু তাকে আগে থেকে স্টাডি করতে হয়েছে। তাদের লাইফস্টাইল, সেখানে কী কী ঘটতে পারে; এবং শেষে যখন তারা ঘরটা খুলে নিয়ে যাচ্ছে, চালটা খুলে আরেক জায়গায় লাগানো হচ্ছে, এর কোনোটাই  কিন্তু তাদের আগাম জানা সম্ভব ছিলো না। আসলে এইটা একটা অসম্ভব জার্নি! যে জার্নিটা ওই বিপর্যস্ত মানুষগুলো করেছে এবং সেই জার্নি তুলে আনার জন্য কামার আহমাদ সাইমন, সারা আফরীন ও তাদের টিম এক ধরনের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েই গেছে।

সবমিলিয়ে ছবিটা আমাদেরকে মুগ্ধ করেছে। আমি জানি, সাইমন ভাই এইখানে তার ছবিটা দেখাতে পেরে কতোটা স্বস্তিবোধ করেছেন। তিনি লোকার্নোর মতো জায়গায়, বড়ো পর্দায় খুব বিরাট সুন্দর অডিটোরিয়ামে ছবিটা দেখিয়েছেন। কিন্তু আমি জানি তিনি তারেক মাসুদ দ্বারা প্রভাবিত। ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’ বলে আমরা যাকে জানি, তিনিই তারেক মাসুদ। তিনি ছবি তৈরি করে নিজে সেই ছবি একেবারে দর্শক পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাঁধে প্রজেক্টর, স্ক্রিন নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আসলে আমাদের বাস্তবতাটা এমনই। চলচ্চিত্রগুলো দেখাতে গিয়েও অনেক রকম বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়। বেশ অনেক দিন ধরে কামার ভাইয়ের অ্যাসিস্টেন্ট সাইফ আলম এবং কামার ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হচ্ছিলো। তো শেষ পর্যন্ত ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ সিনেমাটা প্রদর্শনীর আয়োজন করতে পেরেছে। এজন্য ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’কে আমরা ধন্যবাদ জানাই।

আমরা এবার মামুন হুসাইনের কাছে যাবো। মামুন হুসাইনের উপন্যাস বা অন্যান্য লেখা আমরা যারা পড়েছি, সেখানে দেখেছি যে, অসংখ্য গল্পের কোলাজ এবং এমন একটা রিয়েলিটি তিনি তুলে ধরেন; যা কথাসাহিত্যের দৃশ্যকল্প বুননের এক ধরনের কৌশল। শুনতে কি পাও-এ আমরা কেমন দৃশ্যকল্প দেখতে পেলাম, এটা আমরা শুনবো মামুন ভাইয়ের কাছ থেকে। আমি কেবল একটা সূত্র ধরিয়ে দিলাম। মামুন ভাই নিজের মতো করেই বলবেন। তার পরও এই প্রসঙ্গে কিছু বলে যদি তিনি শুরু করেন।

মামুন হুসাইন : ধন্যবাদ। আসলে যেসব কথা আমি বলবো বলে ভেবেছিলাম, আমাদের দুই গুণী মানুষ, দুই গুণী অধ্যাপক সবকিছু বলে ফেলেছে। আমার মনে হয়, আমি যদি বলতে বসি একেবারেই অপর ভাষা এবং অপর চালাকি করা হবে। আপনারা নিশ্চয় মানবেন, আমি কোনো চলচ্চিত্র বক্তা না। কিন্তু চলচ্চিত্র নামক কালচার ইন্ডাস্ট্রির একজন সাধারণ ভোক্তা হিসেবে যেসব কথা আমি বলতে চাই, সেই কথাটা আমাদের সভার যেকোনো মানুষই এসে বলতে পারবে বলে আমার ধারণা। ভালো চলচ্চিত্র, মন্দ চলচ্চিত্র, এই তফাতে আমি যেতে চাই না। যেমন একটু আগে আপনারা পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন আমাদের কামারকে, উনি লেখক, উনি স্থপতি, উনি ছবি ভালোবাসেন তো বটেই। এবং আমি যদি খুব বিস্মৃত না হই, উনি (কামার) একটা জায়গায় বলছিলেন, আমি ক্লাসিক্যাল ফুলুট বাজাতে চাই এবং বলছেন যে, আমি খুব সহজ মানুষ হতে চাই। সহজ মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে চাই। দূর থেকে যদি কামারের অবয়ব আপনাদের চোখে পড়ে, কামারও নিশ্চয় স্বীকার করবেন, তার ওয়ারিশানদের মধ্যে দেখা যাবে লালন (লালন ফকির) কাজ করেন উনি বলছিলেন এক জায়গায় সুলতানের নাম বলেন, তারাশংকর, মানিকের নাম বলেন, ওয়ালীউল্লাহ আমাদের নাম অবশ্য কেটে দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে বিভূতিভূষণের কথা বলেননি অবশ্য।

আপনাদের নিশ্চয় স্মরণে আছে, সত্যজিৎ যখন স্ক্রিপ্ট করেছেন, উনি বলছেন, বিভূতিভূষণের ন্যারেটিভস এতো প্রস্তুত যে আমাকে খুব বেশি কাটখড় পোড়াতে হয়নি। এবং কামারের নানা সময়ের বক্তব্যের যদি আমি ছিটেফোঁটাও বুঝে থাকি; উনি বলছেন, আমি আসলে এক ধরনের হাইব্রিড লিটারেচার যেটাকে বলে—যেখান থেকে যা পাওয়া যায়—মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেট করার জন্য যতো রকমের উপকরণ, উপাদান সংযুক্ত করা যায়, সেগুলো উনি সাহসের সঙ্গে করেছেন। এই যে নোনা মানুষগুলো বার বার আমার মনে হচ্ছিলো আমাদের মহান শিল্পী এস এম সুলতানের কোনো মানুষ দেখছি কি না। কালো মাটি, একেবারে বিপুল জনস্রোত; এই রকম কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়া মানুষ আমরা খুব কাছাকাছি সময়ে দেখতে পেয়েছি বলে আমার নিজের কখনো স্মরণ হয় না।

কামারের কথাতেই বলি, কামার বলছেন, এই দেশের, এই ভূ-মণ্ডলের বিশেষ করে বাংলাদেশের কথা যদি বলতে চাই, সেখানে যদি নদীর প্রসঙ্গ না আসে, এবং নদী ও মানুষের প্রসঙ্গ না আসে, তাহলে সেটা আমার কোনো বলাই হলো না। কামারের সঙ্গে আমার ওই অর্থে যোগাযোগ নেই। তারেক মাসুদকে চিনতাম। কাগজের ফুল, যতোদূর স্মরণে পড়ে, কামার সেখানে আর্ট ডিরেকশনে কাজ করেছিলেন। আরেকটু স্মরণে পড়ে, যেখানে কামার বলছেন, আমি আসলে সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র শিখেছি। এটা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কামার সাহিত্যের কাছে শিখেছেন। কাজেই আমার মনে হয়, এটা যোগাযোগের একটা উপায়; এটা খুব বিঘ্ন হয়েছে বলে মনে আমার হয় না সাহিত্যের মানুষ আবার চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেছেন। এই যে এখানে কামারের চলচ্চিত্র ত্রয়ীর কথা বলা হচ্ছে, আমরা সবগুলো চলচ্চিত্র মিলিয়ে যদি আবার কখনো দেখতে পারতাম, জানি না সেটা হবে কিনা। তার নাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেমন তিনি তিনটি নাম বলছেন শুনতে কি পাওঅন্যদিন ...আরো কিছু জীবন

আমি যখন বরিশালে চাকরি করি, তখন আমার এক পুরোহিত মশাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো। ফাদার তুরাঞ্জু; উনি কানাডিয়ান ফাদার ছিলেন। উনি ক্যাথলিক ডাইজেস্ট উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ বললেন যে দেখো, ইনি আমাদের ব্রাদার, কিন্তু উনি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানান গড ফ্রে রিজিও (God Frey Reggio, আমেরিকান ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্রনির্মাতা)। উচ্চারণটা আমার ঠিক হলো কিনা জানি না! তার The Qatsi ট্রিলজি। উনি বলছেন, উনি ব্রাদার হতে চান এবং ১৪ বছর ধ্যানের পর গিয়ে তিনি ছবি করবেন বলে যেকোনোভাবে দৃঢ় মনস্থির করেন। তো আজকের এই ছবি যখন দেখছিলাম—তার যে শিরোনাম, এতে কিছুই প্রমাণ হয় না যে সেখান থেকে (কাট্সি ট্রিলজি) কোনো বীজ উড়ে আসতেই পারে। তাতে প্রমাণ হয় না যে, এই চলচ্চিত্রের নামের মধ্যে কোনো খুঁত তৈরি হয়েছে। যেমন ওনার চলচ্চিত্রগুলোর নাম ছিলো লাইফ আউট অব ব্যালেন্স (১৯৮২), লাইফ ইন ট্রান্সফরমেশন (১৯৮৮) এবং লাইফ অ্যাজ ওয়ার (২০০২)।

আমি যদি ট্রিলজির নামটা একটু চিন্তা করি, তাহলে এ রকম একটা বীজ আমার কাছে সামান্য উড়ে আসে। আজকের এই চলচ্চিত্রের কারিগরি দিক নিয়ে কিছু বলার কোনো শক্তি, সাহস এবং যোগ্যতা আমি রাখি না। কতোভাবে যে আজকের এই নির্মাণটি পাঠ করা যায় কিছু কিছু কথা আমাদের সম্মানিত অধ্যাপকরা বলেছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে যে, এটা নৃবিজ্ঞানের এক ধরনের ফিল্ড নোটের মতো। কিছু মানুষ একটা জনপদে গেছে এবং পুরো ঋতু দেখছে; দেখতে দেখতে সেগুলোর ডকুমেন্ট তৈরি করেছে। এবং অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরি হয়েছে। আপনারা জানেন যে, এই ট্রিলজি মানে কামারের যে ট্রিলজি আছে। উনি বলছেন, দক্ষিণবঙ্গ থেকে ঢাকা অভিমুখী যে মানুষগুলো যাচ্ছে। যেটাকে আমরা বলি ক্লাইমেট রিফিউজিস। এবং উত্তরবঙ্গের একটা পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে একসময় কাজ হয়। এই ক্লাইমেট রিফিউজি, এটা যে কতো বড়ো একটা সমস্যা! যারা পরিসংখ্যানের দিকে খেয়াল রাখে, তারা বলছে যে, অ্যারাউন্ড টু থাউজেন্ডস পিপলস এভরিডে দে আর মাইগ্রেটেড টু ঢাকা।

তারা ক্লাইমেট রিফিউজি হয়ে চলে যাচ্ছে। আমাদের এই রকম আইলা, সিডরের মতো ডিজাস্টারের কারণে পরবর্তী সময়ে যে পরিমাণ ট্রমা হয় মানুষের জীবনে, সেই ট্রমার কিছু ছায়া এনে বোধহয়আমার যে সামান্য বিদ্যা তা নিয়ে হয়তো আমি আরেকটু অনুপ্রাণিত, আরেকটু প্রোণিত হতে পারতাম। বিশেষ করে উদ্বেগ হয়, বিষাদ হয়, বহু সুইসাইডাল অ্যাটেম্পড হয় একটি শব্দ আপনারা জানেন যখন একটা জনপদ ভেসে যায়, তখন সেই জনপদের শুধু গাছ ভাসে না, জনপদের শুধু বৃক্ষ উৎপাটিত হয় না, ওই মানুষগুলোর স্মৃতিও হারিয়ে যায়। এই যে তীব্র জলস্রোত দেখাচ্ছেন তিনি (কামার); একটা করে স্মৃতি, স্বপ্ন, মায়া, সেগুলো ক্রমাগত জলে দ্রবীভূত হতে থাকে। সেই ছায়াটা কোনোভাবে নির্মাণ করা যায় কি না, সেটারই হয়তো প্রচেষ্টা কামার করেছেন বলে আমার ধারণা। এবং একটি অদ্ভুত স্বপ্ন তৈরি করেছেন।

আমি মনে করি, ওনার নিজের হাতের তৈরি একক স্বপ্নটি আজকে আমরা সম্মিলিতভাবে দেখতে পেলাম। অপরের তৈরি স্বপ্নে আমরা নিজে দ্রবীভূত হলাম। উনি আর্কিটেক্টের মানুষ, আপনারা জানেন। আর্কিটেকচারের যারা গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তারা বলে যে, এই কর্মটি আসলে ফ্রোজেন মিউজিকের মতো। আর চলচ্চিত্র হচ্ছে লিভিং মিউজিকের মতো। কাজেই কামার মূলত স্থাপত্যবিদ্যার সঙ্গে একটু করে পদ্য, সঙ্গীত ও সাহিত্য মিশিয়ে, শেষ পর্যন্ত নিজেকেই নির্মাণ করেছেন অথবা খোদাই করেছেন—আমাদের সময়, আমাদের ছোটো সময়, ব্যক্তিগত সময়, আমাদের চতুর্পার্শ্বের সময় এবং নিজেকে। আমার কাছে এটুকুই মনে হয়েছে। আবার যদি কখনো কথা বলার সুযোগ হয়, কথা বলবো, ধন্যবাদ। [দর্শকের হাততালি]

(চলবে)

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন