Magic Lanthon

               

রিপন নাথ

প্রকাশিত ৩০ জুন ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

শব্দ আর শব্দহীনতার কল্পনা ধ্বনির রাজ্যে বসবাস

রিপন নাথ



[‘শব্দ আর শব্দহীনতার কল্পনা ধ্বনির রাজ্যে বসবাস' শিরোনামের ‘ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা ১১’-এর প্রথম পর্ব ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ সংখ্যা ২৬, জানুয়ারি ২০২৪-এ মুদ্রিত হয়। ‘কথামালার’ শেষ পর্বটি সরাসরি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হলো।]


দ্বিতীয় পর্ব, সংখ্যা ২৭, জুলাই ২০২৪

রিপন নাথ : এবার আসেন মিউজিক প্রসঙ্গে। মিউজিকের জন্য কখনো ফিল্ম না, ফিল্মের জন্য মিউজিক; ফিল্মের ক্যারেক্টার হিসাব করে মিউজিক। আমি কি খুব বেশি কথা বলছি? [দর্শকের দিক থেকে, কোনো সমস্যা নাই, বলেন] মিউজিকটা বলেই শেষ করবো। সাউন্ড আসলে একদিনে বোঝানো ডিফিকাল্ট। কারণ এটার সঙ্গে অনেক কিছু রিলেটেড। আমাদের ফিল্মগুলোতে মিউজিশিয়ান কেবল মিউজিক করে দিয়ে দেয়। তখন সিনেমা একদিকে যায়, আর মিউজিক আরেকদিকে। আমাদের ম্যাক্সিমাম ফিল্মে এই সমস্যাটা ফেইস করতে হয়।


১৫০, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একাডেমিক ভবন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩


আমরা যখন হাওয়ার মিউজিক করেছি, তখন কিন্তু প্রত্যেকটা ইন্সট্রুমেন্ট সুমন ভাই নিজে বসে ঠিক করেছেন, কোন ফ্রিকোয়েন্সি দিলে এটা ব্লেন্ড হবে না, কোন ফ্রিকোয়েন্সি দিলে এটা ছবি থেকে আলাদা হয়ে যাবে না। মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট চুজ করাও একটা ফ্যাক্ট। এবং ওইটাই আসলে আপনার ইল্যুশন তৈরি করতে পারবে, ওই স্পেসে আপনাকে নিয়ে যাবে। ফিল্ম মেকিংয়ে এটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু মিউজিক করে আসলাম বিষয়টা মোটেও এমন না। সেটাকে প্রোডাক্টিভ করতে হলে অবশ্যই আপনাকে সঠিক ইন্সট্রুমেন্ট যেমন নিতে হবে, সেইসঙ্গে ফিল্মের সঙ্গে ব্লেন্ড করে মিউজিকটা করতে হবে। যাইহোক, আমরা মনে হয় অনেক কথা বলে ফেলেছি। এখন আমরা শেষ করতে পারি। এরপর আপনাদের প্রশ্ন করার পর্ব আছে। আমার বলা শেষ। ঠিক আছে, আমি তাহলে বসি।

ফারজানা তন্বী : ধন্যবাদ রিপন নাথকে। দীর্ঘ আলোচনা শুনলাম আমরা। দর্শক, নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে আপনাদের কাছে আমাদের সদস্যরা কাগজ পৌঁছে দিয়েছে। রিপন নাথের আলোচনার সময় আপনাদের মনে যে প্রশ্নগুলো এসেছে নিশ্চয় সেগুলো সেই কাগজে লিখেছেন। ‛ম্যাজিক লণ্ঠন' এর সদস্যদের অনুরোধ করবো কাগজগুলো সংগ্রহ করে আলোচকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

কাজী মামুন হায়দার, শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ : রিপন ভাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। একটা বিষয় স্মরণ করার প্রয়োজন বোধ করছি। আপনারা জানেন আজ বাংলাদেশের জনপ্রিয় নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান মারা গেছেন। ‛ম্যাজিক লণ্ঠন' পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা তার জন্য শোক প্রকাশ করছি। এবং তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক মিনিট নীরবতা পালন করছি। ধন্যবাদ সবাইকে। এবার আমরা প্রশ্নোত্তর পর্বে চলে যাচ্ছি।

অয়ন, দর্শক : শব্দ গ্রহণের ক্ষেত্রে আপনি কি এমন কিছু সিনেমার নাম বলবেন, যেগুলোর শব্দগ্রহণ আপনাকে অনুপ্রাণিত করে; কিংবা আপনি ভাবেন, ওই রকমের শব্দগ্রহণ করতে পারলে ভালো হতো?

রিপন : আসলে সবই তো বলে ফেলেছি। আমি অ্যাকচুয়ালি ক্রিস্টোফার নোলান-এর সিনেমা দেখে যেমন অনুপ্রাণিত হই, আবার কমার্শিয়াল কোনো সিনেমা দেখেও হই। একেক সিনেমার পারসেপশন একেক রকম থাকে। এগ্জ্যাক্টলি শব্দ এমন একটা জিনিস, এখানে অনেক কিছুই কানেক্টেড। আমি ইন্ডিভিজ্যুয়ালি অনেক শব্দ শুনি যে শব্দটা শুনে কিংবা ছবিতেও এমন সব শব্দ শুনে, যেটা থেকে অনেক এক্সাইটেড হয়েছি। এটা কীভাবে হলো! আমি তখন চিন্তা করি, ওরা যে সাউন্ডটা করেছে সেটা কোন পয়েন্ট অব ভিউ থেকে করেছে। এটা এক ধরনের বিষয়। যেটা আপনাদের কাছে মনে হতে পারে বোরিং। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়, আমি তখন ভাবি, ও আচ্ছা এই এগজাজারেশন বোঝানোর জন্য এটা করেছে। আমি লাস্ট জেলাস ফিল করেছিলাম বোহেমিয়ান (বোহেমিয়ান র‌্যাপসোডি, ২০১৮) দেখে। আপনারা দেখেছেন কি না? ওই সিনেমাটা যে স্পেস ক্রিয়েট করেছে মিউজিকের, সাউন্ডের, অডিয়েন্সের লেয়ারে লেয়ারে, আই কান্ট এক্সপ্লেইন দ্যাট! মানে আপনাদেরকে এক্সপ্লেইন করতে পারবো না, কিন্তু আমার ভেতরে সেটা ঈর্ষা তৈরি করছে যে, এই ব্লেন্ডটা ও করেছে! এখানে অডিয়েন্স, এর পরের লেয়ারে আরেকটা অডিয়েন্স, তার পরের লেয়ারে আরেকটা অডিয়েন্স।

এই যে ডিফারেন্ট ডিফারেন্ট বিষয় ইউজ করে স্পেস ক্রিয়েট করেছে সেই স্পেস ক্রিয়েট নিয়ে আমার খুব ঈর্ষা জাগছিলো। তখন মনে হয়েছিলো ছবিটার মতো যদি একটা সাউন্ড ক্রিয়েট করতে পারতাম! যদি আমার এমন একটা সুযোগ হতো। এই যে স্পেস ক্রিয়েট করা, সেটার সঙ্গে মিলিয়ে পারস্পেক্টিভ ক্রিয়েট করাএমনিতেই সাউন্ড ডিজাইন করা যায়তবে এই স্পেসিং করা সো টাফ! পরে আমি দেখেছি যে, এইটা করতে ওর ছয় মাস লেগেছে, বিকজ অব লেয়ারিং। লেয়ারিং করে করে রেকর্ডিং করেছে, হুইস ইজ টু এক্সপেন্সিভ। সো ইট্স পসিবল। আমাদের জন্যও পসিবল।

অনেক মর্ডান ছবির সাউন্ড আমি দেখেছি সিম্পল সাউন্ড করেছেশুধু বাতাস, হেঁটে যাওয়ার শব্দ। কিন্তু, ও যে ডিজাইনটা করেছে আমি নিজে নিজে ভাবছিও যেটা করেছে–সেটা ওদের পক্ষেই সম্ভব! কারণ ডিরেক্টর ওকে ওই স্পেসটা দিয়েছে। এই বিষয়টা শুধু আমার ভাবনাতে থাকলেই হবে না, ডিরেক্টরের ভাবনাতেও এই কোলাবরেশনটা থাকতে হবে। ওনার যদি ভিশনটা অনেক বড়ো হয়, তাহলে এগুলো করা সম্ভব এবং আমি সেটা বিলিভ করি। আর একটা বিষয়, শব্দ দিয়ে এখন আমরা বাইরের যেকোনো সিনেমার সঙ্গে ফাইট করার ক্ষমতা রাখি। অ্যাট লিস্ট এটা বলতে পারি, আমরা শব্দের ব্যবহারের দিক দিয়ে অনেক এগিয়েছি এবং আরো এগোবো।

অয়ন : আমার সেকেন্ড প্রশ্ন হলো, আমাদের শব্দ গ্রহণের কোয়ালিটি কোন মাত্রায় রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

রিপন : আমি মনে করি, শব্দ গ্রহণে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। বাট ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড আমরা এখনো এনশিওর করতে পারিনি। আমাদের ছবি এখন ‛নেটফ্লিক্স'-এ যায়, ‛অ্যামাজন প্রাইম'-এও যায়। ওরা তো কিউ সি (কোয়ালিটি কন্ট্রোল) ছাড়া কোনো ধরনের অ্যাপ্রুভাল দেয় না। ওরা যখন হলিউডের ছবি করে তখনো আমাদেরকে খোঁজে, সাউন্ডের জন্য অ্যাট লিস্ট খোঁজে। ‛বিবিসি' সাউন্ড করতে চাইলে খোঁজে। কিংবা ‛ন্যাশনাল জিওগ্রাফি'র সাউন্ড করতে চাইলে বাংলাদেশকে খোঁজে। তার মানে তারা কনফিডেন্ট থাকে বাংলাদেশ থেকেও এটা পসিবল। আমার মনে হয়, ভালোভাবেই আমরা এই জায়গাটা অর্জন করতে পেরেছি। এটা আমাদের সবার অ্যাচিভমেন্ট। ইটস অ্যা গুড সাইন আমাদের জেনারেশনের জন্য।

জান্নাতুন নাঈম দোলা, শিক্ষার্থী, ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট : কখন থেকে এবং কেনো আপনার মনে হয়েছিলো শব্দ নিয়ে কাজ করবেন? এই কাজের প্রতি ভালো লাগার শুরু কীভাবে?

রিপন : আমি ছোটোবেলা থেকেইছোটোবেলা বলতে আসলে আমি যখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়িতখন থেকেই আমি মিউজিক শুনতাম। মিউজিক শুনতে শুনতে আমার যেটা প্রবলেম হতোআমি ক্যাসেট প্লেয়ারে মিউজিক শুনতে কোনোভাবেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম না। কারণ ক্যাসেট প্লেয়ারে সাউন্ডটা একটু ফ্লাকচুয়েট করে, সাউন্ডটা কখনো একটু আটকায় যায়। আমি ওটা নিতে পারতাম না। আমি ওয়েট করতাম এটার কখন সিডি বের হবে। দুই টাকা, পাঁচ টাকা এভাবে করে জমাতাম। টাকা জমিয়ে ২০০-২৫০ টাকা হলে সিডি কিনতাম। তখন এগুলোর দাম ছিলো ২৫০ টাকা। এই ২৫০ টাকা জমাতে আমার মিনিমাম আড়াই মাস লাগতো। টাকাটা খুব কষ্ট করে জমাতে হতো। টিউশনি বা এটা-ওটা করে জমাতাম। তার পর সিডি কিনে গান শুনতাম। এভাবে আমি মিউজিক শুনতাম।

তখন থেকে আমার মধ্যে সাউন্ডের প্রতি এই ভালোবাসাটা তৈরি হয়। এটার শুরু আসলে মনের অজান্তেই। আমি যখন গান শুনতাম, তখন আমাদের বাড়ির পাশে পত্রিকার একজন সাংবাদিক থাকতেন। তাকে আপনারা চিনবেন হয়তো। উনি বলতেন এই ছেলে সারাদিন এতো গান শোনে কেনো! যখনই আসতেন তখনই দেখতেন গান শুনছি। উনি প্রায়ই অন্যদের কাছে বলতেন ও আসলে গান-পাগল একটা ছেলে। এভাবে তখন থেকেই মনের অজান্তে শব্দের যে ক্লিয়ারিটি মানে ক্লিয়ার শব্দ শোনার যে অভ্যাস শুরু হয়েছিলো, পরে সেটা আস্তে আস্তে আমার কাজের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলো। আমি যখন এগুলোতে ঢুকি, পাড়ার লোকজন, বাবা, সবাই বলতো, আমি কেনো এসব করছি? কোনো ব্যাংকে বা সরকারি চাকরি কেনো করছি না? আমার বাবা ছিলেন রেলওয়েতে। আমি তখন ঢাকায় এসেছি, খুবই অল্প টাকা দিয়ে কাজ শুরু করেছি। ১৬ টাকা দিয়ে তখন ভাত খেতাম। এভাবে করেই আমি সাউন্ড শিখেছি।

একা করতে করতে একপর্যায়ে ‛বিবিসি'র সাথে কাজ করা। তার পর বাইরে যাওয়া। এভাবে ধীরে ধীরে সাউন্ডের সাথে আমার বসবাস। বাবার স্বপ্নটা হয়তো পূরণ করতে পারিনি; অবশ্য পরে তিনি মেনে নিয়েছিলেন।

মোস্তাহিদ প্রধান, শিক্ষার্থী, মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগ : বর্তমানের বিশ্বখ্যাত শব্দগ্রাহক হ্যান্স জিমা'র ডুন (২০২১) সিনেমার পরিবেশকে জীবন্ত করার জন্য অনেক দিন একাকী মরুভূমিতে তাঁবু খাটিয়ে থেকেছেন এবং সেখানকার শব্দ ধরার চেষ্টা করেছেন। আপনার কি এমন কোনো অভিজ্ঞতা আছে?

রিপন : আমার প্রথম সিনেমা ছিলো ব্যাচেলর। তখন আমি পেছনে দাঁড়িয়ে থাকি, টুকটাক রেকর্ড করি। আমি প্রথমবার নিজে মনপুরাতে ল্যাপটপ ও মাইক্রোফোন নিয়ে গিয়ে নদীতে বসে ওই বাতাসটা রেকর্ডের ট্রাই করেছি। চরের ছাগলের যে শব্দ সেটা রেকর্ড করার ট্রাই করেছি। চঞ্চল যে দৌড়ায়ে যায়, সেই দৌড়ানোর সাউন্ডটাও রেকর্ড করেছি। সেটা ২০০৭ বা ২০০৯-এর ঘটনা ছিলো; আমার ঠিক মনে পড়ছে না। তখনই আসলে আমি এটা এক্সপ্লোর করে ফেলেছি।

তখন ওই রেকর্ডিং করতে আমরা একটা ছোট্টো ডিঙি নৌকা নিয়ে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় এমন ঝড়ের ভেতর পড়েছিলাম, মনে হচ্ছিলো এই বুঝি নৌকাটা ডুবে যাবে! আমি তখন চাকরি করি। আমার সঙ্গে তখন অফিসের মাইক্রোফোন, রেকর্ডার–তখন তো অ্যানালগে রেকর্ড হতো, মানে ম্যাগনেটেড রেকর্ড হতো। তবে মাইক্রোফোনটা অনেক দামি ছিলো। যেটা এখনো পর্যন্ত ইউনিক লোকেশন রেকর্ডিংয়ের জন্য। সেই মাইক্রোফোনটাই ছিলো, সঙ্গে একটা ড্যাট [ডিজিটাল অডিও ট্যাপ, DAT] রেকর্ডার। যেটাতে ডটে রেকর্ড হতো, কিন্তু ম্যাগনেট। তখন এ ধরনের টেকনোলজি ছিলো। ওটা দিয়েই রেকর্ড করেছিলাম আমরা; সারাদিন রোদের মধ্যে বসে। পুরো বাতাসটা যখন ছনের মধ্যে বাড়ি খায়ওই সাউন্ডটা রেকর্ডের জন্য ছনের মধ্যে বসেছিলাম। বলতে পারেন, এভাবেই করেছি! এটা আসলে কোনো স্টুডিও কিংবা স্টক সাউন্ডে পসিবল নয়। যেটা আয়নাবাজিহাওয়াতেও হয় নাই।

তার পরে যদি বলি, আপনারা কেউ ডুব দেখেছেন কি না? অবশ্যই সেটা থিয়েটারে হতে হবে, বড়ো থিয়েটারে। অন্য কোথাও দেখলে হবে না। সেখানে বাতাসের যে সাউন্ড রয়েছে, বাংলাদেশে এমন শব্দ আর কোথাও নাই। এর ইউজ হয়নি কোথাও [দর্শকের মধ্য থেকে কেউ একজন বলেন, ওটা মনে হয় কোনো পাহাড়ে করা]। হ্যাঁ, ওটা সীতাকুণ্ডের পাহাড়ে শ্যুট করা। বাতাস রেকর্ড করতে ওইখানে গিয়ে বসেছিলাম। ভিজ্যুয়াল দেখে দেখে বাতাসের সঙ্গে কানেক্ট করতে হয়েছে। আর সরয়ার [মোস্তফা সরয়ার ফারুকী] ভাইতো খুবই খুঁতখুঁতে। কানে যে সাউন্ড আসছে, ওটা শুনে উনি বলতেন, রিপন আমি তো পাচ্ছি না। আমার এই রকম লাগবে। ওনার থেকে অ্যাপ্রুভাল পাওয়া সো টাফ থিংস। এই জায়গায় আমার নিজেরও কনভিন্স হওয়ার বিষয় কাজ করে। আগে আমাকে কনভিন্স হতে হবে, এইবার সাউন্ডটা ঠিক আছে। ওই শনশনে বাতাসটা শোনা যাচ্ছে। ওখানকার যেই বাতাস ওই লোকেশন ছাড়া সেটা কোনোভাবেই রেকর্ড করা সম্ভব ছিলো না।

মোস্তাহিদ : বাংলা চলচ্চিত্রে যেখানে দর্শক প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রী ছাড়া কাউকে তেমনভাবে ক্রেডিট দেয় না, সেখানে শব্দগ্রাহকের মতো থ্যাংকলেস কাজ করার ক্ষেত্রে কীভাবে নিজেকে অনুপ্রাণিত করেন?

রিপন : ভেরি নাইস কোয়েশ্চেন। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে কেউই সেভাবে সাউন্ডের কাজ করতে চায় না। কারণ সাউন্ড করলে সেটা দিয়ে সারভাইভ করতে পারবে না। কেননা কোনো ডিরেক্টরেরই সাউন্ডের জন্য আলাদা কোনো বাজেট থাকে না। অবশ্য এখন পরিস্থিতি কিছুটা ইম্প্রুভ করেছে। কিন্তু আমি বিলিভ করতাম যে, এই সাউন্ড আমি আমার মতো করে করবো এবং সেটা গাটস নিয়েই করবো। দিস ইজ ভেরি ট্রু–আমি যা করবো সেটা গাটস নিয়েই করবোকরবা আমার সাথে কাজ? যদি এভাবে হয় আসো, না হলে নাই। আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, আমি আসলে কাজটাকে রেসপেক্ট করেছি। কাজটাকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি সবসময়। এই চ্যালেঞ্জ নিতে নিতেই হয়তো আজকে আপনারা আমাকে চিনেছেন। সেই চ্যালেঞ্জের কারণেই আজকে আমি আপনাদের সঙ্গে বসে কথা বলতেছি।

একবার হয়েছে কী, ভিড় ঠেলে আমি আসাদুজ্জামান নূর ভাই ও সৈয়দ শামসুল হক স্যারের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম। আমার জেদ ছিলো আমি অটোগ্রাফ নিবোই। এদের প্রত্যেকের সঙ্গে আমার কাজের অভিজ্ঞতা আছে। আমি কাজের মধ্য দিয়ে কষ্ট করে হলেও তাদের কাছে যেতে পেরেছি। থ্যাংকস গড যে, সেই সুযোগটা আমাকে তিনি দিয়েছেন। কাজের মাধ্যমে আমি আপনাদের ভালোবাসা পাচ্ছি কেবল এই শব্দ করেই। আমার দিক থেকে আমি খুবই প্রাইড ফিল করি যে, আমি সাউন্ডের কাজ করি। আমি ঢাকা শহরে অ্যাট লিস্ট ফাইট করতে পারবো, দিস ইজ নট থ্যাংকলেস জব। এখন আপনারা অন্তত এটা বুঝতে পারছেন, সাউন্ড ছাড়া কিউ সি [কোয়ালিটি কন্ট্রোল] আর হবে না। কোনো ইন্টারন্যাশনাল প্লাটফর্ম কিউ সি যদি না থাকে, ডিসটর্টেড সাউন্ড তারা নিবে না। সাউন্ডের কাজ করার মতো এখন প্লাটফর্ম তৈরি হয়েছে। সেটা আরো ভালো জায়গায় যাবে। এখানে আরেকটা বিষয়, আমার সঙ্গে একবার যারা কাজ করে, তাকে যেই রেসপেক্ট দিই, যেভাবে মিশি, তারা আসলে আমার সঙ্গে দ্বিতীয় বার কাজ করতে ভুলবে না। আমি অবশ্যই সেই চেষ্টাটা করি, আমার সর্বোচ্চটা দেওয়ার।

রীতা জান্নাত, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ : বিভূতিভূষণ-এর ’আরণ্যক’পড়ার সময় রাতের যে নির্জনতা সেটাকে উনি অনেকগুলো শব্দ ও বাক্যে জীবন্ত করেছেন বলেই অনুভব করেছি নির্জনতার শব্দটা। কিন্তু ভিজ্যুয়ালে তো সেই ভাবনার প্রয়োজন হয় না। আমরা সেটা চোখের সামনে দেখতে পারি শব্দ ও শব্দহীনতা দিয়ে। সিনেমা ও সাহিত্যে শব্দের ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে দেখবেন?

রিপন : এই বিষয়টা আমি আমার কথাতেই বলেছি অনেকটা। আপনারা আয়নাবাজি কে কে দেখেছেন? ওখানে একটা সিকোয়েন্সের কথা কি মনে আছে, যেখানে চঞ্চল ভাই একটা রুমের মধ্যে বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলেনফুল, পাখি, লতা-পাতা, ঝড়, বৃষ্টি, বাঘ ইত্যাদি নিয়ে [মূকাভিনয় করে দেখিয়ে]। মনে আছে এই সিকোয়েন্সটার কথা? সাড়ে চার মিনিটের সিকোয়েন্স ছিলো এটা। ওই জায়গায় সেই অর্থে কিছুই ছিলো না। এখানে আমরা আস্তে আস্তে বাতাস, পাখির ডাক, কিচিরমিচির, ঝিঝি পোকার শব্দ দিয়ে সিচুয়েশনটা ক্রিয়েট করি। সেখানে তিনি আসলে বাচ্চাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে গল্পটা বলতে থাকেন। কিন্তু ইমেজে তখন সাউন্ড থাকে। যখন তিনি বাঘের গর্জন দিয়ে ওঠেন, তখন ছেলেটা সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে কান্না করে দেয়। ইটস অ্যা সেইম থিং। আমরা সেইটা এক্সপ্লোর করে ফেলেছি। শুধু এই সিনেমায় না, আমরা অনেকগুলো সিনেমাতেই এই জিনিসটা এক্সপ্লোর করেছি। শিল্পের সঙ্গে কল্পনার এই সম্মিলন আমাদের অনেক ডিরেক্টররাই করেছে। হয়তো ভবিষ্যতে আরো নতুন কিছু করবো, যদি সুযোগ পাই আরকি।

মমিনুল ইসলাম, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ : শব্দ কি একা কখনো চলচ্চিত্রের ইমেজ তৈরি করে? যদি করে থাকে তাহলে শব্দের সঙ্গে ইমেজের সংমিশ্রণ কীভাবে ঘটে?

রিপন : ধরেন, একটা বনের মধ্যে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আপনি শুধু ক্যামেরাটা ধরে রাখছেন। সেখানে শুধু বাতাস, কিচিরমিচির, পাখির শব্দ। সেসময় একটা গাড়ি আসলোখট খট খট খট, বুউম করে থামলো। থেমে খট খট খট করে নামলো। নেমে খস খস খস করে দৌড় দিলো কেউ। এরপর ঠাস করে গুলির শব্দ হলো। চিৎকার করে একজন পড়ে গেলো। কী হবে তখন? ওই ইমেজ শেষ। আপনি কী বুঝতে পারছেন কী ঘটলো? তার মানে নিশ্চয় বুঝতে পারলেন শব্দ দিয়ে ইমেজ তৈরি করা সম্ভব। এবং স্ক্রিনটা যখন নাই হয়ে গেলো, তখন আপনার মাথায় এটা থাকবে যে কী হলো। আসলেই কি ওই পাশে কোনো ঘটনা ঘটছে? কী ঘটছে, কীভাবে ঘটছে? আমি এটা বিলিভ করিশব্দ দিয়ে ইমেজ তৈরি করা সম্ভব।

আমি গতকালকেও একটা শর্টফিল্মের সাউন্ড করেছি। ডিরেক্টরকে আমি যখন বললাম, আপনি যেভাবে ডিজাইনটা করেছেন ইট্স কম্পিলিটলি রঙ। কীভাবে রঙ? একটা লোক কানে শুনতে পান না। কিন্তু আপনি ইমেজে যেটা দেখাচ্ছেন, সামনে দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে, ধাম করে গাড়িটা ব্রেক করলো। হুট করে তার পেছন দিয়ে একটা মেয়ে দৌড়ে চলে গেলো। একজন এসে বলতেছে, এই মিয়া এখানে কী করতেছেন, সরেন। তারপর ওই ক্যারেক্টারটা চিৎকার করে কান্না করতে থাকলো। এই যে ইমেজ, এটা যদি আমি ক্যামেরায় ধরি, আপনি তখন কার গল্প বলবেন? ওই ক্যারেক্টারের গল্প বলবেন, নাকি যেই চোখটা দিয়ে দেখতেছেন সেই চোখের গল্প বলবেন? ইট্স কম্পিলিটলি ডিপেন্ড অন ডিরেক্টর। যদি চোখ দিয়ে দেখেন তাহলে ওই ক্যারেক্টারের কষ্টটা আর বুঝতে পারবেন না। যদি আপনি ক্যারেক্টারের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখেন, তাহলে ইমেজ দিয়ে শব্দ ক্রিয়েট করতে পারবেন। গাড়িটা যে সে দাঁড় করালো সেটা তিনি শুনতে পারলেন না, কিন্তু আপনি বুঝলেনপেছন থেকে কেউ বলছে, ওই মিয়া কি করতেছেন, সরেন এখান থেকে। তার মানে আপনি ভিজ্যুয়াল দিয়েও দেখতে পারছেন। ইমেজ দিয়ে আপনি শব্দ শুনতে পারছেন। যখন ওই ক্যারেক্টারটা হাউমাউ করে কান্নাকাটি করছে, আমি কেনো শুনতে পারছি না। ওই শব্দটা আপনি শুনতে পারছেন না। তবে দেখা যাবে যে, ওর মুখ দিয়ে কিছু বের হচ্ছে না; ওটা দেখে আপনি কিন্তু বুকে ঠিকই কষ্ট নিয়ে বের হবেন। তার মানে হচ্ছে ইমেজ দিয়েও শব্দ শোনা যায়।

তুহিন ইমরুল, শিক্ষার্থী, নাট্যকলা বিভাগ : যেসব সিনেমায় সময় নিয়ে কাজ করতে পারেন, যেমন, হাওয়া; সেই সব সিনেমা এবং যেসব সিনেমায় সময় কম পান, পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক সিনেমাএই দুইয়ের মধ্যে আপনার কাজের প্ল্যানে কী ধরনের পার্থক্য থাকে?

রিপন : গুড কোয়েশ্চেন। যেসব সিনেমায় কাজ করতে হয়, সেগুলোতে প্রপারলি-ই কাজ করতে হয়। আর যেগুলোতে নাম যায়, সেখানে জোর করেই নাম যায়। মিনিমাম লেভেলের স্ট্যান্ডার্ড যে মেইনটেইন করবো সেই সময়টা পর্যন্ত থাকে না। কেনো থাকে না? কারণ ওই ডিরেক্টর আগের রাতে চ্যানেলে নাটক ডেলিভারি দিয়েছে, আর পরের রাতে মিউজিক ও সাউন্ড করে আরেকটা কাজ সকালে জমা দিয়েছে। ওই ডিরেক্টর বিলিভ করে, এক রাতেই এটা পসিবল। এ ধরনের অনেক কাজ আছে যেগুলোতে একটা স্ট্যাটাস মেইনটেইনের জন্য আমার নামটা ইউজ করতে হয়।

মো. হারুন অর রশিদ, প্রতিবেদক, ‛এখন টিভি', রাজশাহী অফিস : একজন রিপন নাথ হয়ে ওঠার পেছনে সংগ্রামের গল্পটা একটু বলবেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শব্দগ্রহণকে পেশা হিসেবে নেওয়াটা নিশ্চয় চ্যালেঞ্জের?

রিপন : সংগ্রামের গল্পটা একবার বলেছি। একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, একজন ডিরেক্টর বা এডিটরের কাজ যেরকম চোখে দেখা যায়, সাউন্ড কিন্তু চোখে দেখা যায় না। এটা শুনতে হয়। যেহেতু শুনতে হয়, ইট্স সো টাফ! যখনই কেউ কাজ করতে আসে, দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে হয় সে এটা ছেড়ে দেয়, না হয় ভালোভাবে না শিখেই নিজে অন্য কোথাও কাজ করতে থাকে। কিন্তু অ্যাকচুয়ালি এটাকে কমপ্লিট প্রফেশন হিসেবে নেওয়ার জন্য, মিনিমাম ফাইভ ইয়ার্স-এর স্ট্রাগল মেইনটেইন করতে হয়। যদি সাউন্ড নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে আসা একটা ছেলে থাকেসে তো পড়ে আসছেহি নোজ হোয়াট ইজ কিলোবাইট, বিট, ফ্রিকোয়েন্সি, কম্প্রেশার, ইকুয়ালাইজার, এভরিথিং হি নোজ। কিন্তু প্র্যাকটিকালি সাউন্ড শুনতে পারাআমি যেমন রেকর্ড করে এখানে কোন ফ্রিকোয়েন্সির সঙ্গে কোন ফ্রিকোয়েন্সিটার ক্ল্যাশ রয়েছে দেখাতে পারবো। এটা কিন্তু অভিজ্ঞতার বিষয়, ইট্স নট মাই ক্রেডিট। আমি যতোটুকু বুঝতে পারি সেটা আমার অভিজ্ঞতা। ইট্স রিয়েলি ভেরি টাফ। আমার অভিজ্ঞতায় যতোটুকু আমি বুঝি, শব্দকে রিড করতে পারাটা আসলেই সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এইটা রিড করতে পারার পরেই আসলে কাজটা শুরু হয়।

হারুন : আমি আসলে যেটা জানতে চাচ্ছিলাম, ধরুন আমি একজন শব্দগ্রাহক হতে চাই। এখন বাংলাদেশে যেসব সিনেমা দেখে আমি অন্তত বড়ো হয়েছি, সেই সিনেমাতে তো শব্দের যানজট ছিলো। আমরা ডিপজল, মান্নার সিনেমা দেখে বড়ো হয়েছি; আমাদের জেনারেশন মানে আমরা যারা গ্রামে ছিলাম। আমার মনে হয়েছে, ওইসব সিনেমার ডিরেক্টররা আসলে শব্দকে কোনো প্রাধান্যই দিতো না। এখন প্রশ্ন, সেখানে আপনি কী করে শব্দ নিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেন? এই ডিরেক্টরদের সঙ্গে আপনার মিশেলটা কীভাবে হলো? আমি চাইলে হয়তো একটা সিনেমা করতে পারি; টাকা খরচ করে লোকজন ভাড়া করে। করলামও। কিন্তু আপনি তো শব্দ নিয়ে কাজ করছেন। এই ইন্ডাস্ট্রিতে আপনি কীভাবে টিকে গেলেন? এই টিকে যাওয়ার পেছনে যদি কোনো গল্প থাকে, তাহলে সেটা একটু বলবেন।

রিপন : আমি টিকে গেলাম বলতে আসলে, ওই যে বললাম, আমি একরকম গাঁটসাট বেঁধে বসেছিলাম। একদম বসেই ছিলাম। বিকজ অব, আমি যে কাজটা করতে চাই সেটাই করবো। এইভাবেই বসেছিলাম। আমাদের আগের ফিল্মমেকারদের কাছে যে টেকনোলজি ছিলো, যে স্টাইলে সাউন্ড করতে হতো, যারা সাউন্ড করতো, তারা যেভাবে করতো, তাদেরটা আর না-ই বলি। কিন্তু আমার কাছে খুব পীড়াদায়ক ছিলো জিনিসটা। পীড়াদায়ক ছিলো এই কারণে যে, আমি যে জিনিসটা শুনতে চাচ্ছি, তা শুনতে পাচ্ছি না। আমার প্ল্যান ছিলো আমি ওই জিনিসটা শোনাতে চাই। আমি আমার দর্শকের কান পর্যন্ত সেটা পৌঁছাতে চাই। সেই চিন্তা থেকেই আসলে আমার এই কাজ করা।

শুরু থেকে আমি আস্তে আস্তে নিজেকে এক্সপ্লোর করি। কীভাবে এই সাউন্ডটা এক্সপ্লোর করা যায়; কীভাবে একটা ডিফারেন্স তৈরি করা যায়; কীভাবে একটা সাউন্ডের সঙ্গে আরেকটা সাউন্ডের ক্ল্যাশটা রোধ করা যায়এগুলো পড়াশোনা করতে থাকি। পরে আস্তে আস্তে জানতে পারি, দেখতে পাই যে, এটা কমপ্লিটলি ফ্রিকোয়েন্সির খেলা। ফ্রিকোয়েন্সি, এয়ার প্রেশার এবং ম্যাথ্স-এর খেলা। এইভাবে এক্সপ্লোর করতে করতে এখন যে সব পারি তা বলছি না; যতোটুকু পারি আমার জায়গা থেকে চেষ্টা করি। ওই চেষ্টা থেকেই সাউন্ড করে আসছি এবং করছি। ওই যে ক্লিয়ারিটি বের করা, কীভাবে বের করা যায়, বের করার জন্য কী প্রসিডিউর মেইনটেইন করতে হবে, কী টেকনোলজি মেইনটেইন করতে হবে, সেগুলো ট্রাই করেই আমি আসলে কাজ করি বেসিকলি।

কেনো মুম্বাইয়ের সাউন্ড এ রকম হয়, কেনো সাউথ এর সাউন্ড এ রকম হয়, কেনো হলিউডের সাউন্ড এ রকম শোনায়, আমাদেরটা কেনো ও রকম শোনায় না। ওদের কাজ রিসার্চ করে করে, সেখান থেকে এক্সপেরিমেন্ট করে করেই আসলে আমি আমার জায়গাটা ক্লিয়ার করার চেষ্টা করেছি। এই চেষ্টা থেকেই আমি সাউন্ড করি। এখনো ধরেন, কোনো একটা নতুন কিছু পেলে আমি কোনো না কোনো কাজে এক্সপ্লোর করি। আমি যে কয়েকটা সিরিজ করেছি, প্রত্যেকটাতে ভিন্ন ধরনের সাউন্ড করেছি। কিন্তু নো ওয়ান আন্ডারস্ট্যান্ডস দ্যাট, আমি আসলে কী করছি! আমি কমপ্লিটলি আলাদা ধরনের ফ্রিকোয়েন্সি ইউজ করেছি। এই যে নিজের সাথে নিজে এক্সপেরিমেন্ট করা, এটা কেউ বুঝতে পারবে না, না ডিরেক্টর, না ওই প্লাটফর্ম।

এই যে নিজে নিজে এক্সপেরিমেন্ট আমার নিজের একটা ধাপকে উতরায়ে দেওয়া; আমি অন্য কোনো একটা কাজ দেখে ইন্সপায়ার হয়ে এটা করেছি। এইভাবেই নিজেকে এক্সপ্লোর করেছি, করছি। আমি বলবো যে, আমরা যেভাবে স্ট্রাগল করে এখানে আসছি, এখন জিনিসটা অনেক ইজি। বিকজ অব, এখন সাউন্ডের প্লাটফর্ম তৈরি হয়েছে। এখন সাউন্ড ডিজাইনার বলতে গেলে নাই। কিন্তু হিউজ অ্যামাউন্ট অব ওয়ার্ক অ্যাকচুয়ালি মেইনটেইন হয়েছে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে। সো, সাউন্ড করলে আমি ডেফিনেটলি বলবো, প্রথম পাঁচ বছর তাকে স্ট্রাগল করতেই হবে। সে জায়গাটা যদি কারো থাকে, সে ভালো জায়গায় যাবে।

মেঘনা রহমান, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাকিতকা বিভাগ : আমার আসলে এই বিষয়টা সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণাই নাই, তার পরও একটু কথা বলতে চাই। সত্যজিৎ রায়ের একটা শর্টফিল্ম আছে টু। সেখানে কোনো ভাষা (সংলাপ) ইউজ করা হয় নাই। শুধু শব্দ, আর আপনি যে মিউজিকের কথা বললেন সেটার ব্যবহার করা হয়েছে। আমি ওই শর্টফিল্মটা দেখেছি, সেখানে একটা কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। আপনি যেহেতু শব্দ নিয়ে কাজ করেন, কোনো একটা কাহিনি কি শুধু শব্দ ব্যবহার করে বলা যায়?

রিপন : হ্যাঁ, ডেফিনেটলি।

মেঘনা : মানে, শব্দ আর ইমেজ দিয়ে কোনো একটা কাহিনি ফুটে উঠলো। আর শব্দের যে কাজ সেটা আপনি করলেন।

রিপন : আপনি আসলে একটা আইডিয়া বলছেন। কোনো ডিরেক্টর যদি এই ধরনের আইডিয়া জেনারেট করে, আমি ডেফিনেটলি সেটা করবো।

মেঘনা : মানে, এ রকম কাজ যদি আমরা পাই আরকি। আপনি যেহেতু কাজ করছেন।

রিপন : আমি তো ডিজাইনার, নট অ্যা ডিরেক্টর। এটা কোনো ডিরেক্টরের ভাবনা থেকে আসতে হবে। কোনো ডিরেক্টরের ভাবনা থেকে যদি আসে, দেন আমরা সেই ডিজাইনটা করবো। ইট্স পসিবল।

কাজী মামুন হায়দার : ধন্যবাদ। আমাকে এখানে আবারও আসতে হলো। স্ট্রাগলের গল্প শুনছিলাম। আমাদের কাছেও স্ট্রাগলের নাম ‛ম্যাজিক লণ্ঠন'। কারণ ধরেন, শব্দের মতো একটা বিষয় নিয়ে এ রকম একটা আয়োজন করা সহজ কোনো বিষয় না। এখন পর্যন্ত যদি ৫০ জন মানুষও এখানে থাকে সেটাও খুব বড়ো ধরনের অর্জন। কারণ, শব্দ তো আমাদের কারো চিন্তার মধ্যেই নাই! আমরা এক ধরনের ঝুঁকি নিয়েই এই ধরনের আয়োজন করেছি। আমার মনে হয়, আমরা সফল হয়েছি। এখন পর্যন্ত আপনারা শব্দ নিয়ে কথা শুনছেন। ধন্যবাদ জানাচ্ছি আপনাদের।

দ্বিতীয় কথা হলো, আমাদের এখানে উপস্থিত আছেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ, কথাসাহিত্যিক মামুন হুসাইন। উনি আমাদের বেশিরভাগ আয়োজনেই থাকেন। ওনার কথা না শুনলে আসলে এ ধরনের আয়োজন পূর্ণতা পায় না। কারণ, আমরা দেখেছি যখন হাওয়া নিয়ে কথা হয়েছে, সেখানেও মামুন ভাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মত নিয়ে হাজির হয়েছেন। ওনার কথার একটা ভিন্ন ধরনের পারস্পেক্টিভ থাকে। শব্দ একটা অন্য ধরনের জিনিস। যদিও উনি অন্য এক ধরনের শব্দ নিয়েই খেলা করেন। তার শব্দ, তার কথাসাহিত্য, সেই শব্দ অন্য ধরনের। এটা আরেক শব্দ। আমি কথাসাহিত্যিক মামুন হুসাইনকে অনুরোধ করবো কিছু বলার জন্য।

আরো একজন গুণী মানুষ আছেন এখানে, রহমান রাজু। বাংলাদেশের থিয়েটারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ তিনি। উনি থিয়েটার নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পত্রিকা ‛আনর্ত' সম্পাদনা করেন। আগে আমরা রহমান রাজুর কথা শুনবো, তার পর মামুন হুসাইন বলবেন। আসছেন রহমান রাজু।

রহমান রাজু : শুভেচ্ছা সবাইকে। আজকে মনে হলো, আমি, মামুন ভাই [মামুন হুসাইন] শিক্ষার্থী হয়ে এখানে ক্লাস করলাম। যেমনটা মামুন হায়দার বললেন, মামুন ভাইয়ের কাছে শব্দ একরকম, রিপন নাথের কাছে একরকম, আমার কাছে একরকম। আমি যখন শব্দ পড়েছি, এইভাবে পড়েছি যে, কয়েকটি বর্ণ পাশাপাশি বসে যে অর্থপূর্ণ রূপ দেয় তাকে শব্দ বলে। যার ইংরেজি হচ্ছে ওয়ার্ড। তখন আমরা ইংরেজি সাউন্ড শিখেছি, সাউন্ড কী? ব্যাকরণ পড়ে শিখেছি, অর্থহীন আওয়াজকে সাউন্ড বলে। অর্থাৎ, ধ্বনি, যেটাকে বলা হচ্ছে ধ্বনির রাজ্যে বসবাস। তার মানে অর্থহীন আওয়াজ হচ্ছে আমার কাছে সাউন্ড, ধ্বনি। আর বর্ণের পর বর্ণ বসে যে অর্থপূর্ণ রূপ নেয় সেটা হচ্ছে শব্দ। এইভাবে আমরা বড়ো হয়েছি। ধন্যবাদ।

মামুন হুসাইন : সেই বিকেল থেকে লম্বা বক্তব্য চলছে। আমি জানি না এই মুহূর্তে আর কথা বলা ঠিক হবে কিনা। আমাদের কাজী মামুন বললেন, অনুষ্ঠান আয়োজন করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ; আমি বোধহয় আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। আমরা বর্তমানে এমন একটা প্রজন্ম পাড়ি দিচ্ছি যারা অমনোযোগিতায় অতি আসক্ত। এ রকম একটা সভায় মনোযোগ ধরে রাখাআমার মনে হয় যারা এখানে প্রধান শোভা মানে দর্শক, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ যে তারা এখনো চূড়ান্তভাবে আমাদের বর্জন করেনি।

আজকের এই কথামালার প্রধান ঋত্বিক, মানে দূর থেকে যার নাম দেখতামরিপন নাথ। এই ধরনের চলচ্চিত্রের মানুষকে ছুঁয়ে দেখা, যেমন মোস্তফা সরয়ার ফারুকীযখন আমরা পিজি হোস্টেলে পড়তাম, তখন শাহবাগে তার সঙ্গে দেখা হতো, চা খেতাম। তখন প্রায় কাছাকাছি বসে খেয়েছি হয়তো, এখন আর ফারুকীকে স্পর্শ করা বোধহয় সম্ভব নয়। রিপনকে একটু স্পর্শ করতে পারলাম বটে। একটু আগে আমার তরুণ বন্ধু রাজু কথা বলছিলেন, আপনারাও শুনছিলেন, খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচনা হচ্ছিলো। বিষয় হচ্ছে যে, শুনতে পারাটাও একটি শিল্পকর্মদ্য আর্ট অব লিসেনিংএখানে তার [রিপন] সব কথা আমরা বুঝতে পারিনি, এটা আমাদের অক্ষমতা। কারণ যে বিষয়গুলো নিয়ে তিনি কথা বলছিলেনআমাদের একজন তরুণ বন্ধুও কথা বলছিলেন, তার প্রজন্মে চলচ্চিত্রে শব্দ বলে কোনো বিষয়ই ছিলো না, সেই জায়গা থেকে এককভাবে লড়াই করে আজকে একটা জায়গায় পৌঁছান রিপন নাথ, সেটা খুব সহজ নয়।

তিনি বলছেন, ঠিক কী করতে হবে, হোয়াট ইজ টু বি ডান। এই জন্য প্রত্যেকের জার্নি ডিফারেন্স এবং দেখবেন এর মধ্যে রিপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেনওয়ান শ্যুড হ্যাভ দ্য কারেজ টু বি ডিজলাইকডআমাকে মানুষ অপছন্দ করছে, এটা সাহসের সঙ্গে নিতে শেখাতিনি বার বার নিজেকে বলছেন নেপথ্যের মানুষ। আমার কাছে মনে হয়, এসব হীনম্মন্য শব্দ। উনি যে কাজ করছেন তা কখনোই ক্ষুদ্র কাজ বলে আমার মনে হয় না। আমি হিচককের একটা লেখা পড়েছি; হিচকক বলতেন, যারা ন্যারেটিভ ফিল্ম তৈরি করে সেখানে পরিচালক ঈশ্বরের মতো কাজ করে। যিনি ডকুমেন্টরি ছবি তৈরি করেন¾রিপন বললেন তিনি ’বিবিসি’র সঙ্গে কাজ করেছেন। শব্দগ্রাহকহি বিকাম দ্য ...তিনিও ঈশ্বরের মতো হয়ে যান। ফলে এই কাজ আমার কাছে কখনোই ছোটো বলে মনে হয় না।

আজকের বক্তৃতায় আমার আরেকটা ঝুঁকি হচ্ছে, আপনারা এতোক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা শুনলেন আর এখন শুনছেন গুরুত্বহীন বক্তৃতা। এখানে সুবিধাও আছে। সুবিধা হচ্ছে যে, আপনারা গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা আলাদা করে ধরতে পারবেন, এই সুবিধাটা একটা মেসেজ হতে পারে। আমার যে সামান্য জানাশোনা বা ধরুন ছবি দেখতে দেখতে যেসব ধারণা তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে দুই-একটা কথা বলবো কিনা, বক্তৃতা আরো বেশি লম্বা হয়ে যাবে কিনা, সেটাও ভেবেছি।

রাজুর কথাই বলি, যেমন সাউন্ড তো ইংরেজি শব্দ। আমরা যা বলি সবই শব্দ-বর্ণ, ধ্বনি। ওনাকে যদি বলতাম উনি চলচ্চিত্রের শব্দগ্রাহক না আওয়াজ গ্রাহক। কিংবা যদি উনি বলতেন যে তিনি পরিচালক, আওয়াজ! তারপর ভেবেছি যে না, আওয়াজ শব্দের মধ্যে বোধহয় একটা আবেগীয় যে ধ্বনিময়তা, সেটা কোথাও হোঁচট খাচ্ছে। এই জন্যে আবার শব্দে ফিরছি। শব্দ যদি বর্ণ, অক্ষর হয়, আর উনি যদি সেই শব্দ চারপাশ থেকে খোঁজেন, আমার কাছে খুব তফাত বলে মনে হয় না। একটা শব্দ আছে আপনারা পেয়েছেন কিনালেক্সোফাইল (Lexophile)কিছু কিছু মানুষ আছে যারা শব্দ খুঁজে বেড়ায়। শব্দ মানে এখানে অক্ষর, ধ্বনি, বর্ণ খুঁজে বেড়ায়। যেমন রিপন নাথ হয়তো শেয়ার করতে পারবেন, ফলি আর্টিস্ট কিছু আছেন, এই ফলি আর্টিস্ট নিয়ে কৌশিক গাঙ্গুলি ছবি তৈরি করেছেন শব্দ নামে। কৌশিক গাঙ্গুলির ছবিতে দেখবেন যে নানা ধরনের জায়গা থেকে শব্দ আহরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। শব্দ তাকে এতোটাই তাড়িত করছে যে, শব্দের মধ্যে ডুবতে ডুবতে হি বিকাম সিক, লোকজন তাকে অসুস্থ মনে করছে। বিষয়টা আমার কাছে মনে হয় নানা স্তরে এর ব্যাখ্যা হতে পারে। আজকের এই সভাটি আমার কাছে তেমন মনে হয় না।

আমরা যখন একদম লেখাপড়া শিখতে শুরু করলাম, ফিজিক্সের বইয়ে তখন সাউন্ডের একটা সংজ্ঞা খুঁজে পেলাম। কিন্তু এটা যে এতো বিশাল, এটা যে পড়তে হয়, সেটা অনেক পরে জানতে পেরেছি। আমি যে বিষয়ে বিদ্যাব্যবসায়ী, আপনারা জানেন সেখানে একটি শব্দ আছেসাইকোঅ্যাকোস্টিকস (Psychoacoustics)যেকোনো শব্দ আমরা কানে শুনি না কিন্তু। আপনারা দেখেছেন, রিপন বার বার বলছেন, ওটা অনুভব করতে শেখায়। শব্দ হচ্ছে এমন কিছু পাওয়া, যা দিয়ে দূর থেকে আপনাকে স্পর্শ করতে পারবো। আমি এখন রাজুকে স্পর্শ করতে পারছি না, বাট আই মেক সাম সাউন্ড, আমি তাকে স্পর্শ করতে পারি। আমি যতোটুকু বুঝিআমি নিজে চলচ্চিত্র তৈরি করিনিছবি দেখতে দেখতে যে বিষয়গুলো মনে হয়েছে। যেমন ধরুন, ব্যাটলশিপ পটেমকিন দেখছি, আপনারাও নিশ্চয় দেখেছেন, কাজী মামুন নিশ্চয় দেখিয়েছেন। যখন আমরা চার্লি চ্যাপলিন দেখছি, দোজ আর দ্য ভেরি সাইলেন্ট ফিল্ম, কিন্তু কখনো মনে হয়নি যে কোথাও হোঁচট খাচ্ছে।

আজকে তারেক মাসুদের কথা বলছিলাম, তিনি একবার বলেছিলেন, আমরা একসময় নির্বাক ছবি দেখতাম, কিন্তু নির্বাক ছবির মধ্যে একটা শিশিরের শব্দ পেতাম। আর আমাদের চলচ্চিত্রে কী যে শুরু হলো, বকবকানি শুরু হয়ে গেলো। তিনি ঠিক বকবকানি শব্দটাই বলেছিলেন। এরপর তিনি একবার বলছিলেন, কিছু না, শব্দের মধ্য দিয়েই মনে হবে এই মুহূর্তে একটি হত্যাযজ্ঞ তৈরি হয়ে গেলো। যেসব ছবি দেখে আমরা বড়ো হচ্ছিলাম-যেমন আমার এখনো মনে পড়ে লাঠিয়াল-এ আমাদের নায়ক ফারুক দেখতাম মায়ের কবরের উপর গিয়ে চিৎকার করে প্রায় দুই-চার মিনিট ক্রন্দন করলেন। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হলো যে, মা মৃত্যুবরণ করেছেন। বহুদিন ধরে আমি ভেবেছি, এটা আর কীভাবে বলা যেতো, মানে এটা মনে হচ্ছে একদম নাটক, পুরো যাত্রার মতো, কোনো ভাষাই তৈরি হয়নি। ফিল্ম যে একটি ল্যাঙ্গুয়েজ, ফটোগ্রাফি যে একটি ল্যাঙ্গুয়েজ, সেই বিষয়টি কিন্তু তৈরি হয়নি। এটা কিন্তু আমার কাছে অনেক দিন আক্ষেপের মতো মনে হয়েছে।

আজকে শব্দ, ভাষা এবং এর মনস্তত্ত্ব নিয়ে এতো বেশি কাজ হচ্ছে, আপনারা দেখবেন সবার কাছে যেসব স্মার্ট যন্ত্র আছে, দেখবেন শব্দ নিয়ে কতো গবেষণা চলছে পৃথিবীতে। যেমন কিছু গবেষণাতে বলা হচ্ছে, এমন কিছু শব্দ আছে যে শব্দগুলো আমাদের মধ্যে খুব আনন্দের অনুভূতি, নিরাপত্তার অনুভূতি তৈরি করে। এর কিছু ক্যাটাগরি করা হয়েছে, যারা সাউন্ড নিয়ে কাজ করেছে। যেমন বলছেন যে শরৎকালে-যেহেতু সাহেবদের তথ্য তোসেখানে অটাম ফল হয়, গাছের পাতা পড়তে থাকে, সেই পাতার উপর দিয়ে যখন হেঁটে যায়, ওতে যে শব্দ সেই শব্দে প্রশান্তি আসে। বা ধরুন আপনি কাঠ পোড়াচ্ছেন, বনের মধ্যে যখন বন ফায়ার হয়, বনের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছেন, বলা হচ্ছে ওই শব্দটা এক ধরনের প্রশান্তি নিয়ে আসে। এটার সঙ্গে জেনেটিকালি একটি কথা বলা হয়, যখন মানুষ সভ্য হচ্ছে, একটু একটু করে বন দখল করতে হচ্ছে, বনকে বসবাসের উপযুক্ত করতে হচ্ছে। এই যে বন একটু একটু করে আড়াল হয়ে নিজের প্রতিবেশ তৈরি করছে, সো দিজ ফিল ভেরি হ্যাপি। এই জায়গাগুলো তারা কিছু ক্যাটাগোরাইজ করছে।

তার পর বলছে যে, নদীর শব্দ, ঢেউয়ের শব্দ, পাখির শব্দ, একটা প্রশান্তির জায়গা তৈরি করে। একইভাবে আরো কিছু শব্দ আছে¾এখন যারা কগনেটিভ সায়েন্স নিয়ে কাজ করছেনযেগুলো ঘৃণা উদ্রেক করে। যেমন একটা বোতল নিয়ে রিপন হয়তো ভবিষ্যতে এ নিয়ে আরো অনেক গবেষণা করতে পারেনবোতলের মধ্যে যখন আপনি চাকু বা ছুরি দিয়ে স্ট্রাক করেন দে হ্যাভ অ্যা ভেরি ফিলিং হেইট্রিড অন। কিংবা পাকা মেঝের উপর কোনো কিছু টানতে শুরু করেছেন, কখনো শান দিচ্ছেন, খুব দ্রুত সাইকেল ব্রেক করছেনএম আই টি'তে একটি গবেষণায় তারা বলছেন, এই শব্দগুলো আমাদের মধ্যে হেইট্রিড তৈরি করে। যাইহোক, আমার বক্তব্য মনে হয় এলোমেলো হচ্ছে। আমি আলোচনা গুটিয়ে নিয়ে আসি; আসলে সিনেমা বলি, ফিল্ম বলিওই যে রিপন বললেন সাউন্ড ইফেক্ট তৈরি করে। আসলে প্রত্যেকটি স্পেসের মধ্যে দেখবেন যে একটা পোয়েটিক্স থাকে। এবং শব্দকে কিন্তু আমার কাছে কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো মনে হয় না।

আমার কাছে সবসময় মনে হয়, শব্দ একটি অদৃশ্য চরিত্র, কারণ এই শব্দ, যে ন্যারেটিভ, যে স্টোরিটা রয়েছে তার গভীরতা তৈরি করছে। শব্দ আমার কাছে কখনো কখনো বিরতি চিহ্নের মতো মনে হয়। বিরতি চিহ্ন কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ; অনেকে বুঝতে পারেন কিনা জানি না। গদ্যের মধ্যেও কিন্তু একটা ছন্দ থাকে। কাজেই একটা ফ্রেম থেকে আরেকটা ফ্রেমে যে হঠাৎ করে একটা শব্দ আসে আমার কাছে, এটা মনে হয় তা পাঙ্চুয়েশনের মতো কি না? শব্দটা তৈরি করা হয়উনি কিছু বিষয়কে খুব গুরুত্ব দিতে চান অথবা চরিত্রের ভেতরের কিছু অন্তর্গত ফিসফিস শব্দ থাকে, অনুভব থাকে, সেটা কিন্তু তিনি ধরার চেষ্টা করেন।

কাজেই আমার কাছে কখনোই মনে হয় না যে উনি শুধু মেশিন নিয়ে কাজ করেন। উনি বললেন যে, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ে আসা মানুষ, আর শব্দ নির্মাণের শিল্পী হওয়াআমার কাছে মনে হয় যে, এটা শিল্পী হওয়ারই একটি কঠিন ব্রত এবং যাত্রা। সেই কাজটি বাংলাদেশের মতো জায়গায় বসেআজকে কয়েকটি কথা তিনি বলেছেন, যদি কোথাও শব্দ নিয়ে কাজ করা হয় তাহলে রিপনের মতো মানুষকে কিন্তু খোঁজা হয়। আমি মনে করি, আমাদের দেশে যেহেতু, আপনি যদি ক্রিকেটে ছয় মারতে না পারেন, ওই পর্যন্ত মানে প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়াতে পারবেন না। কিন্তু উনি পুরো রাষ্ট্রের হয়ে যে একটা অ্যাম্বাসেডরের কাজ করেন, সেটা এখন পর্যন্ত বুঝবার কোনো মনীষা আমাদের এই সোনার বঙ্গে তৈরি হয় নাই। এটা আমাদের গ্লানির, লজ্জার ও বেদনার কথাআমি সেই কথাটি বলার চেষ্টা করছিলাম। ওই যে পোয়েটিকাল স্পেস, সেই জন্য আমার কাছে মনে হয় শব্দের একটা কাজও ছোটো নয়।

তাহলে কী হচ্ছে, এর মধ্যে উনি একটা কথা বলেছেন মিউজিক নিয়ে। আপনাদের ইশারা দিয়ে রাখি একটা বইয়ের ব্যাপারে ‛দ্য মিউজিক অব ফুরিয়া'। ইনি একজন নিউরো সায়েন্টিস্ট। বইটা হচ্ছে, শব্দগুলো মাঝে মাঝে কানে আসে, লোকে বলতো ও নাকি সঙ্গীত পাগল মানুষ। ফুরিয়া মানে ভালোবাসা। বার বার সঙ্গীতের কাছে যাচ্ছে, মিউজিক ফুরিয়া। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, কিছু কিছু মানুষ এতো চেষ্টা করার পরও কিন্তু শব্দ, ধ্বনি, নান্দনিক সৌন্দর্য কিছুই ধরতে পারছে না মিসোফোনিয়া (Misophonia) বলে। পাঁচ জনের একজন সঠিক শব্দ পার্সিভ করতে পারে না। আমরা কিছু কিছু রোগী পাই, যাদের মিউজিক শুনতে শুনতে মৃগী রোগের মতো খিঁচুনি শুরু হয়, যাকে ‛মিউজিক্যাল এপিলেপসি' বলে।

যাইহোক, আমরা হয়তো শব্দ থেকে অনেক দূরে ছড়িয়ে যাচ্ছি। মূলত আমাদের বলবার বিষয় ছিলো, উনি যে জায়গা থেকে কাজ করছেন বিষয়টি কিন্তু আরো বড়ো দূরের পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখতে পারলে আমাদের মনে হয় চিন্তার জায়গাগুলো আরো লম্বা ও ছড়িয়ে যায়। আজকে যদি এখানে শঙ্খ ঘোষ থাকতেনএখানে আমাদের অনেক বন্ধুরা আছেন, সাহিত্যিক বন্ধুতিনি এক্ষুনি আমাকে থামিয়ে দিতেন, বলতেন, এতো কথা বলো কেনো? শব্দহীন হও! তার মানে শব্দ কখনো কখনো অত্যাচার হয়ে যায়, নয়েজ টর্চার। আমাদের ঢাকা শহর নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে নয়েজ টর্চারের জায়গা-ওই যে বললো ডেসিমেল, হাইস্ট ডেসিমেল। এবং এই শব্দ দিয়ে নানা রকমের অত্যাচার বিবর্তন শুরু হয়েছে। রিপনের মতো সৃজনশীল মানুষেরা অনেক দেশে তাদের মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রির কাছে নাম নথিভুক্ত করে এবং সেই শব্দ তৈরি করা হয় অ্যাজ অ্যা ফর্ম অব টর্চার। আপনারা ‛আবু গারিব' কারাগারের নাম শুনেছেন, হিউজ টর্চারের জায়গা, সেখানে সেটা করা হচ্ছে। এমন কিছু অস্ত্র তৈরি করা হচ্ছে, সেগুলোকে মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রি বলছে, উইপোনাইজড সাউন্ড। এ রকম একজন সৃজনশীল মানুষযিনি বলছেন আমি সমস্ত শব্দ লেয়ারে লেয়ারে ধরতে পারবো, সমস্ত শব্দ অনুপুঙ্খ ধরতে পারবো; কিন্তু সেটা অন্য কোনোভাবে অজান্তে দেখেন, ওনার মতো নান্দনিক মানুষের বাইরেও কিছু মানুষ সারা পৃথিবীতে কাজ করছে। কাজেই শব্দ খুব নিরীহ বিষয় না।

আজকে যতো সহজে নান্দনিকতার জায়গা থেকে বলার চেষ্টা করছিলাম, ছড়িয়ে ভাবতে পারলে মনে হয় একটা পরিপ্রেক্ষিত আমাদের মাথার মধ্যে থাকবে। শব্দের কাজ কতোখানি দায়িত্বপূর্ণ হওয়া দরকার সেটা আপনারা খানিক বুঝতে পারবেন। শেষ কথাটা বলি, রবীন্দ্রনাথের ‛মুক্তধারা' নাটকে ঝর্ণাতলায় ওই যে রাজকুমার অভিজিৎ শুয়ে থাকে। শুয়ে থাকো কেনো? কী করো? জলের শব্দ শুনি, সেই শব্দের ভেতর আমি ভাষা শুনি। আমার কাছে এই জায়গাতে মনে হয়, শব্দ, ভাষা, ধ্বনি সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। রিপন মূলত মানুষের সেই ভাষা নির্মাণের কাজ করছেন। সেই জায়গাটা নতুনভাবে, নতুন পরিপ্রেক্ষিতে, নতুন একটা বর্ণমালা রচনা করে সেই অনিঃশেষ যাত্রায় আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতীক হয়ে কাজ করছেন রিপন। এই জন্যই আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ।

আমি রিপন নাথকে ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা জানাই যে, ওনার সামনে আমাকে এসব আজগুবি বক্তৃতা করতে হলো। এবং শেষ একটা কথা বলি, আমরা কিন্তু কখনো কান দিয়ে শুনি না! আমরা কিন্তু মস্তিষ্ক দিয়ে শুনি। এই জন্য শব্দ কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনাকে অনুভব করায়! এজন্য শব্দ শুনতে শুনতে স্মৃতি জাগে-চট করে বললো শব্দ কিন্তু আপনাকে একটা দৃশ্যমান কিছু করে দেখায়। কাজেই এই রকম একটা নতুন ভাষাভঙ্গি, নতুন বিন্যাস নিয়ে উনি কাজ করছেন। আমরা মনে করি, এই একা যাত্রায় ওর যে সাহস তা আমাদের মধ্যে ধারণ করা দরকার। আপনাদের সবাইকে অশেষ কৃতজ্ঞতা।

ফারজানা তন্বী : ধন্যবাদ, মামুন হুসাইনকে। দর্শক, আমরা আয়োজনের একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। সমাপনী বক্তৃতার জন্য এবারে মঞ্চে ডেকে নেবো ‛ম্যাজিক লন্ঠন কথামালা ১১'-এর আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক পুশরাম চন্দ্রকে। সেইসঙ্গে আপনাদেরকে ‛ম্যাজিক লণ্ঠন'-এর অন্য কোনো আয়োজনে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় নিচ্ছি আমিও। সবাই ভালো থাকবেন।

পুশরাম চন্দ্র : শুভেচ্ছা সবাইকে। আমি প্রথমেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি, আমাদের আজকের আয়োজনের অতিথি রিপন নাথকে। সেইসঙ্গে ধন্যবাদ জানাচ্ছি রহমান রাজু স্যার ও কথাসাহিত্যিক মামুন হুসাইনকে, এই আয়োজনে উপস্থিত থেকে তাদের মূল্যবান মতামত হাজির করার জন্য। আজকের অতিথি রিপন নাথ চলচ্চিত্রের একটা জটিল বিষয় শব্দ ও শব্দগ্রহণ নিয়ে দারুণ এক আলোচনা করলেন। সেইসঙ্গে এই কাজ করতে গিয়ে তার যে অভিজ্ঞতা, সেটাও বর্ণনা করেছেন। বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, সাউন্ড কীভাবে তৈরি হয়, কীভাবে কাজ করে, সেটা বোঝাতে গিয়ে তিনি নানা ভঙ্গি নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছেন। দেখে মনে হলো তিনি একজন দক্ষ অভিনয়শিল্পীও। সত্যি বলতে আমি একবার তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, একটু অন্যমনস্ক ছিলাম, তাই হয়তো!

একটা কথা বলা দরকার, চলচ্চিত্র নিয়ে যতো আলোচনা হয় তার বেশিরভাগটাই স্ক্রিনে যারা থাকে তাদের নিয়েই। এর বাইরে যারা কাজ করে, আরো যারা থাকে, তাদেরকে নিয়ে আলোচনা করা হয় না বললেই চলে। তেমনই শব্দ একটা অনালোচিত জিনিস। অথচ সেটা না থাকলে চলচ্চিত্র আর চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে না। এই কাজটাই করেন রিপন নাথ। আমার খুব পছন্দের কয়েকটা সিনেমা আছে হালদা, মনপুরা, আয়নাবাজি এগুলো কয়েকবার দেখা হয়েছে, কিন্তু সিনেমাগুলো যখন দেখেছি, তখন একবারও মনে হয়নি যে এই সিনেমাগুলো এতো ভালো লাগার পেছনে সাউন্ডেরও সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সব কাজ রয়েছে। আজ তার কিছুটা উপলব্ধি করলাম। এবং শুনে ভালো লাগলো, এই কাজ যিনি করেছেন তিনি আমাদের আজকের অতিথি রিপন নাথ। আবারও এজন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই। নিশ্চয় তিনি আরো দারুণ সব কাজ আমাদের উপহার দেবেন।

আজকের আয়োজনে আমাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে যারা এখানে উপস্থিত ছিলেন, এখনো আছেন, তাদের প্রতি ‛ম্যাজিক লণ্ঠন' পরিবারের পক্ষ থেকে অশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ। আমরা আগামীতে চলচ্চিত্রের অন্য কোনো পেশাদার ব্যক্তিকে নিয়ে এমনই আরো অনেক আয়োজন করতে চাই। সেই প্রত্যাশা নিয়ে এবং সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করে আজকের আয়োজনের সমাপ্তি ঘোষণা করছি। ধন্যবাদ।


এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন