আসিফ রহমান সৈকত
প্রকাশিত ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
‘২০১৮ : এভরিওয়ান ইজ এ হিরো’
বন্যা দিয়ে মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রকে বোঝার আখ্যান
আসিফ রহমান সৈকত
এক.
২০১৮ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে কেরালাতে এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে। প্রতি বছরই ওই সময়টাতে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে কেরালাতে টানা বৃষ্টি হয়। কিন্তু ২০১৮’র বৃষ্টির পরিমাণ এমন মাত্রায় পৌঁছে যে তা সর্বকালের অন্যতম কঠিন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে রূপ নেয়। টানা বৃষ্টিতে অচল হয়ে যায় কেরালার একটা বিশাল অংশ। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে অন্যান্য সময়ের তুলনায় ৯৬ শতাংশের বেশি বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আর ইউটিউবে গেলে এই সংক্রান্ত অনেক মর্মান্তিক এবং হৃদয়স্পর্শী ভিডিও পাওয়া যাবে; যেখানে দেখা যাবে মানুষ তার পরিবার নিয়ে আটকা পড়েছে আর তাদেরকে উদ্ধারের জন্য মোবাইল ফোনের ভিডিওতে বার্তা দিচ্ছে। অভাবনীয় এই বৃষ্টিপাতের সঙ্গে যোগ হয় বাঁধ ব্যবস্থাপনার ত্রুটি।
ছোটো-বড়ো ৭০টির বেশি বাঁধ আছে কেরালাতে। এসব বিষয় নিয়ে আই আই টি মাদ্রাজ, পারদু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাও আছে। প্রবল বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৩০০০-এর উপর রিলিফ ক্যাম্প খোলা হয়। যেখানে ১২ লাখের উপর মানুষ আশ্রয় নেয়। ১০ হাজার কিলোমিটারের বেশি নষ্ট হয় রাস্তা। কোচিন বিমানবন্দর রানওয়ে পানিতে তলিয়ে যায়, যেটা কিনা ভারতের চতুর্থ ব্যস্ততম বিমানবন্দর, যা বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের কাছে পরিচিত। বাড়িঘর, সম্পদের ভয়াবহ ক্ষতি হয়। যার আর্থিক মূল্য ৪০ হাজার কোটি রুপির বেশি। এতো উদ্ধার তৎপরতা, এতো সতর্কতা, মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, এতো উদ্যোগের পরেও প্রায় ৫০০ মানুষ নিহত ও নিখোঁজ হয় ভয়াবহ সেই বন্যায়।
এই সবকিছুকে সেলুলয়েডে তুলে ধরা হয়েছে ‘২০১৮ : এভরিওয়ান ইজ এ হিরো’ মালায়ালাম সিনেমায়। চলচ্চিত্রটি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের অস্কার পুরস্কারের জন্যও ভারত থেকে মনোনয়ন পায়।
সারা দুনিয়াতেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে অনেক সিনেমা হয়েছে এবং সেগুলো বাজেটেও অনেক। সিনেমা হিসেবে ‘২০১৮’র বৈশিষ্ট্য হলো, সত্যিকারের সংঘটিত দুর্যোগের ঘটনাকে পর্দায় উপস্থাপনের চেষ্টা। তবে এসব ক্ষেত্রে যেটা হয়, এধরনের ঘটনায় অনেকগুলো পক্ষ জড়িত থাকে। একইসঙ্গে ভারতের যে রাজনৈতিক অবস্থা, সেখানে এই ধরনের একটা ন্যারেটিভকে পর্দায় আনা খুব সহজ ছিলো না।
দুই.
একটা দেশ বেঁচে থাকে মানুষের শক্তিতে। একটা ‘দেশ’ দেশ হয়ে ওঠে মানুষের সম্মিলিত শক্তিতে। প্রতিষ্ঠান, সরকার, রাষ্ট্র¾এসব কিছু তো মানুষের জন্যই, মানুষেরই তৈরি, মানুষের কল্যাণে। শক্তি তো আসলে সেই রাষ্ট্রের মানুষের, তাদের ভেতরের শক্তিই তো আসল শক্তি। একটা দেশ সব থেকে কঠিন পরিস্থিতিও সামাল দিতে পারে মানুষের শক্তি আর ভালোবাসা দিয়ে। তাই হয়তো বলতে দ্বিধা নেই, এটাই আসল কেরালা স্টোরি, এটাই কেরালার গল্প, এটা দক্ষিণ এশিয়ার শত কোটি মানুষের গল্প। তাইতো সিনেমার নাম ‘২০১৮’ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘এভরিওয়ান ইজ এ হিরো’, যার অর্থ প্রত্যেক মানুষই একজন নায়ক।
প্রত্যেক ছোটো ছোটো উদ্যোগ, চেষ্টা, কষ্ট সহ্য করে টিকে থাকা এই মানুষগুলোই একেক জন হিরো; এরাই আসল শাকিব খান, শাহরুখ খান। কেরালার বাস্তব পরিস্থিতির অবলম্বনে জুড অ্যান্টনি জোসেফ পরিচালিত এই সিনেমা। ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে এটি সিনেমাহলে মুক্তি পায়। এবং বক্স অফিসে ২০০ কোটি রুপির বেশি ব্যবসা করে (নির্মাণ ব্যয় ছিলো ২০ কোটি রুপি)। সিনেমাটি ভারতীয় উপমহাদেশে নির্মিত সিনেমার মধ্যে কনটেন্টের জায়গা থেকে যেমন আলাদা, তেমনই ব্যবসায়িকভাবেও সফল। মুসলমান ও জঙ্গিবাদ নিয়ে ‘কেরালা স্টোরি’ নামে একটি সিনেমা একইসময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক কথা হয়েছে, সেটাও ছিলো ভারত থেকে অস্কারের মনোনয়ন দৌড়ে। কিন্তু তা ছিলো কেরালাকে বিভক্ত করার সিনেমা , আর ‘২০১৮’ মানুষের মধ্যে একতাকে উদযাপন করার সিনেমা। আর তাই হয়তো দর্শক ‘২০১৮’ কে গ্রহণ করেছে, বক্স অফিস অন্তত সে কথাই বলে।
তিন.
দুনিয়াতে কোনো একজন মানুষের, একটা প্রাণীর, একটা গাছের জীবন বাঁচানোর থেকে সেরা কাজ আর মনে হয় কিছু হতে পারে না। এসব কাজের থেকে বেশি আনন্দ, স্বস্তি, আধ্যাত্মিক শান্তি আর কোনো কাজে হয় না। এই কাজ মানুষকে মানুষ হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরে। মানুষের সম্মিলিত শক্তির কথা বলে। এই সম্মিলিত শক্তিতেই মানুষ আজকে এতো দূর আসতে পেরেছে। ‘২০১৮’ নিয়ে কথা বলতে গেলে এগুলো বলতেই হয়।
এর বাইরে সিনেমাটির কারিগরি দিক নিয়ে কিছু বলা দরকার। ভি এফ এক্স-এর দারুণ সব ব্যবহার আছে এই সিনেমায়। যখন পানি সরে যাওয়ার জন্য, বাঁধ বা স্লুইস গেট খুলে দেওয়া হয়, তখন হঠাৎ করে দেখা যায়, ক্যামেরা একেবারে পানির ভেতরে ফোকাস করে দ্রুত চলে গেছে গভীরে। সেখানে একটা মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। এই দৃশ্যান্তরটা ছিলো ক্যামেরা থেকে ভি এফ এক্স-এ একটা কাট-এর মাধ্যমে। বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কারণে প্রবল বেগে হঠাৎ করে পানি নীচে পড়া শুরু করলে, সেই পানির প্রবল স্রোতের তোড়ে একটা মাছ শত শত ফুট উপর থেকে নীচে একটা পাথরে জোরে আছাড় খেয়ে পড়লো এবং মরে রক্ত বের হলো। এখানে নির্মাতা সম্ভবত প্রতীকী হিসেবে মানুষের কৃতকার্যের জন্য প্রকৃতিতে মানুষের অজান্তে যে সব অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনৈতিক ব্যাপার ঘটে বা যেসব দুর্ঘটনা ঘটে, যা মানুষেরই সৃষ্টি, যা মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে করে, তার প্রতিশোধ যে পরে প্রকৃতি বিভিন্নভাবে নেয়, সেই ইঙ্গিতটাই করেন।
একইসঙ্গে জরুরি এবং দারুণ একটি ভি এফ এক্স দৃশ্য এটি। ভি এফ এক্স ছাড়া এই দৃশ্য করা সম্ভব ছিলো না। অনেকেই ভি এফ এক্স, ড্রোন ব্যবহার করে অপ্রয়োজনীয় কিছু শট নেয়, যার সঙ্গে সিনেমা ভাষার কখনো কখনো সম্পর্ক থাকে না। কিংবা এই দৃশ্যগুলো না করলে সিনেমার ন্যারেটিভে কিছু বাদ যেতো না , বা কিছু যোগও হয় না, সেই হিসেবে এই দৃশ্যটা ভি এফ এক্স-এর একটা জরুরি ব্যবহারের কথা জানান দেয়। বিশেষ করে কোনো প্রাণীর দৃশ্য ধারণে ভি এফ এক্সের ব্যবহার দারুণ দৃশ্য তৈরি করতে পারে। ‘রোমাঞ্চম’ সিনেমায় ইঁদুরের এইরকম একটা দারুণ ভি এফ এক্স দেখা যায়; ‘ট্রেন টু বুসান’ সিনেমার শুরুতে একটা হরিণের মতো প্রাণীর দুর্ঘটনায় পড়া থেকে শুরু করে সেটার জম্বি হিসেবে ফিরে আসা দেখানো হয়।
চার.
২০২৪ খ্রিস্টাব্দের অস্কারের জন্য ২০২৩-এর সিনেমা হিসেবে ‘২০১৮ : এভরিওয়ান ইজ এ হিরো’ নির্বাচিত হওয়াতে ভালো লেগেছে। ফলাফল যাই হোক না কেনো, ভারত থেকে এই ধরনের একটা সিনেমা যাওয়া মানে এটার দিকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করানো। ভারতের মানুষের শক্তিটা দেখানো। যদিও কেরালার শক্তি বলাই ভালো। পুরো ভারতের সব প্রদেশের মানুষ একইরকম নয়। এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের রংপুরের মানুষের জীবন সংগ্রাম আর ঢাকার মানুষের জীবন সংগ্রামের মধ্যে মিল নাই কোনো; সেটাই স্বাভাবিক।
এই উপমহাদেশের বা পৃথিবীর প্রায় সব দেশই যে জনগণের বা মানুষের শক্তিতেই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে, তার সুন্দর উদাহরণ এই সিনেমা। কেরালার মানুষ এই সিনেমাটা দিয়ে এই উপমহাদেশের মানুষকে আবারও পৃথিবীর সামনে তুলে আনলো। বন্যা, খরা, ভুমি ধ্স, ভুমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়ে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার শত শত গল্প এখনো পর্দায় আসার প্রতীক্ষায় আছে। যে গল্প মানুষের লড়াই করে টিকে থাকার গল্প। যে গল্প শুনে হয়তো অন্য মানুষেরা টিকে থাকার মানসিক শক্তিটা পায়।
পাঁচ.
বাংলাদেশের দর্শক, নির্মাতা, সরকারি অনুদান দেওয়ার লোকজনের কাছে ২০ কোটি টাকা বিশাল বাজেট। কিন্তু যখন জানা যায়, বিশ্বের অন্য অনেক ডিসাস্টার নিয়ে নির্মিত সিনেমার বাজেট ৩০০ থেকে ৫০০ কোটি; তখন ২০ কোটি টাকা বাজেট কিছুই মনে হয় না। যদিও ২০ কোটি টাকার সিনেমা ব্যবসা করেছে ২০০ কোটি। এই সিনেমায় বিশাল একটা এলাকাকে কেন্দ্র করে বন্যার সেট নির্মাণ করতে হয়েছে, অনবরত বৃষ্টি রাখতে হয়েছে।
যদিও বাংলাদেশের দর্শক ওটিটি প্লাটফর্ম ‘সনি লিভ’-এ কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে সিনেমাটি দেখেছে। যেখানেই দেখুক তা মোবাইল ফোনসেট কিংবা ডেস্কটপ-ল্যাপটপের স্ক্রিন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু সিনেমাটি দেখার ক্ষেত্রে বড়ো পর্দা এবং ভালো সাউন্ড সিস্টেম দাবি করে। ফলে কেবল শাহরুখ খান, আমির খানের সিনেমা আনলেই হবে না। বাংলাদেশের মালায়ালাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সাথে সম্পর্ক বাড়ানো দরকার। বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রি থেকে; যারা কনটেন্টকে, গল্পকে কেন্দ্র করে তাদের সিনেমাকে সাজায়। তাদের গল্পই হয়ে উঠে কেন্দ্রীয় আলাপের অংশ; নায়ক-নায়িকা নয়। এছাড়া এই সিনেমার সব থেকে চোখে পড়ার মতো বিষয় হলো এর প্রোডাকশন ডিজাইন এবং সিনেমাটোগ্রাফি; এই ধরনের সেট আপে অল্প বাজেটে যা করা হয়েছে, সেটা অভাবনীয়!
ছয়.
সবার বেঁচে থাকার সংগ্রাম, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, দিন শেষে মানুষ হিসেবে অন্যের প্রতি যে ভালোবাসা, দুর্দশায় পড়া অসহায় মানুষের প্রতি যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, সব কিছু ভুলে গিয়ে মানুষকে বাঁচানোর জন্য যে সম্মিলিত কাজ, তারই আখ্যান ‘২০১৮ : এভরিওয়ান ইজ এ হিরো’। এটাই হয়তো আসল কেরালা স্টোরি, এটাই সত্যিকারের কেরালা, মানবিক কেরালা।
সিনেমার পুরো আখ্যানে একটি চরিত্রকে যদি আলাদা হিসেবে বলতে হয়, সেটা অনুপ। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই সিনেমার মূল চরিত্র, যাকে কেন্দ্র করে সবাই এই সিনেমার সঙ্গে যুক্ত। অনুপ আর্মি থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে এসেছেন। তার হবু স্ত্রী তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, টিভিতে দেখে অন্যরকম কিছু ভেবে তিনি আর্মিতে জয়েন করেন। হিরো হিরো ভাব, নায়কের মতো ব্যাপার স্যাপার চিন্তা করে তিনি আর্মিতে যান। কিন্তু পরে দেখেন, এটা আসলে সেইরকম না, যা তিনি ভেবেছিলেন। ওখানে অনেক পরিশ্রম, অনেক কাজ। তারপরেও তিনি ছিলেন, কিন্তু তার পরিচিত দুইজন সদস্যের মৃত্যু তাকে আহত করে। তার পর তিনি চলে আসেন আর্মি থেকে।
পরে অবশ্য আমরা দেখি তার ওই আর্মি ট্রেনিং তাকে আত্মবিশ্বাসী করে মানুষের বিপদে এগিয়ে আসার। দুর্যোগের সময়ে তার নিরলস পরিশ্রম দর্শককে সেই ধারণাই দেয়। যদিও শেষ পর্যন্ত একজনকে উদ্ধার করতে গিয়ে অনুপ মারা যান। এখান থেকে একটি ভিন্ন বয়ান পাওয়া যায়, নিয়ত ঠিক থাকলে যেকোনো অবস্থানে থেকেই জনগণের স্বার্থে, মানুষের জন্য কাজ করা যায়।
সাত.
সিনেমাটি শুরু হয়েছে বিশেষ ধন্যবাদ দিয়ে। সেখানে যেমন কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারায়ি ভিজায়ান আছেন, তেমনই বিরোধী দলীয় নেতা ভি ডি সাথীশান’কের প্রতিও ‘কৃতজ্ঞতা স্বীকার’ করা হয়েছে। এছাড়া কেরালার সর্বস্তরের মানুষ, প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে। কেরালার কোল্লাম শহরের থাঙ্গাসেরি এলাকায় এর শুটিং হয়েছে। আরব সাগরের তীরবর্তী এই জায়গাটা ঘিরেই ছিলো সিনেমার পরিকল্পনা। সেই এলাকার মানুষের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে। এতো বড়ো এলাকা নিয়ে, এই রকম কাজ করার জন্য এই সহযোগিতার কোনো বিকল্প ছিলো না; যেখানে বাজেটও কম।
মূলত এই সিনেমা নির্মাণের গল্পই মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার গল্প। সিনেমাতে মৎস্যজীবীদের বিরোচিত অবদানকে বিশেষভাবে দেখানো হয়েছে। যখন অতিবর্ষণে পুরো এলাকা প্লাবিত, তখন এই মৎসজীবীরা নিজেদের দায়িত্বে মাছ ধরার নৌকা নিয়ে সরকার এবং প্রশাসনের আগেই উদ্ধার কাজে নেমে পড়ে। এরাই হলো সেই ‘এভরিওয়ান ইজ এ হিরো’-এর হিরো; গল্পের আরেকদল নায়ক।
আরো শুটিং হয়েছে কেরালার কোট্টায়াম জেলার মারাভানথুরুথু গ্রামে; যা জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। সিনেমাতেও দেখা যায়, দুইজন পোলিশ ট্যুরিস্ট যারা ভিডিও ব্লগার (ভ্লগার) হিসেবেও বিখ্যাত; তারা সেই দুর্যোগের সময় কাকতালীয়ভাবে কেরালার এই গ্রামে ঘুরতে আসে। এবং নিজেরাও দুর্যোগ পরিস্থিতির শিকার হয়। সংকটের মধ্যে যখন সব হোটেল বন্ধ, পোলিশ ট্যুরিস্টদের থাকার জায়গা পাওয়া যাচ্ছিলো না, তখন অনুপের বাড়িতে অতিথি হিসেবে তারা থাকার জায়গা পায়। অনুপ মজা করে তার বাবা-মাকে বলেন, সারা দুনিয়ায় তার বন্ধু-বান্ধব আছে, এরা পোল্যান্ড থেকে এসেছে।
কেরালা পৃথিবীর অন্যতম সেরা ঘোরাঘুরির জায়গা। সারা দুনিয়া থেকে মানুষ এখানে ঘুরতে আসে। কেরালার লোকজন বলে, কেরালা হলো সৃষ্টিকর্তার নিজের দেশ। কেরালার অধিবাসী কারো বাসায় থাকা মানে কেরালার সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদেরকে আরো ভালোভাবে পরিচিত করার সুযোগ পাওয়া। এটা অর্থ সাশ্রয়ী এবং সাধারণ মানুষের জন্যও আয়ের ভালো পথ। সাধারণ মানুষের সাথে ট্যুরিস্টদের এই ধরনের যোগাযোগ দিন শেষে দুই পক্ষকেই আনন্দিত এবং আর্থিকভাবে উপকৃত করে।
কোনো পর্যটন এলাকায় সেখানকার মানুষের বিশ্বস্ততা, আন্তরিকতা কতোখানি গুরুত্বপূর্ণ সেই বার্তাটাও দেয় এই সিনেমা। ট্যুরিজমের জায়গা থেকেও এই ব্যাপারটা স্থানীয়দের জন্য ভালো, কারণ এটা তাদের অর্থনৈতিক উন্নতিতে অবদান রাখতে পারে। হোটেল ব্যবসায়ীরা তো পুঁজি খাটায় মুনাফার জন্য। সেখানে স্থানীয়রা খুব বেশি লাভবান হয়, এমন নয়। ফলে স্থানীয় মানুষদেরকে সঙ্গে নিয়ে যদি কমিউনিটি নির্ভর ব্যবসা হয়, সেটা স্থানীয় অধিবাসীর জন্য মঙ্গলজনক হয়। এই সিনেমায় তার ইঙ্গিত আছে।
আট.
প্রতিটা প্রাকৃতিক দুর্যোগই অন্যদের জন্য শুধুই একটা খবর, যতোক্ষণ পর্যন্ত না সেটা তাদেরকে আক্রান্ত করে। এরকম একটা বক্তব্য দিয়ে সিনেমার শুরু। আসলে নিজেরা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে না গেলে আক্রান্তদের অবস্থা উপলব্ধি করতে পারা কঠিন। এছাড়া প্রাথমিকভাবে সাধারণ মানুষেরা মনে করে দুর্যোগে সরকার, প্রশাসনই সব করে ফেলবে। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়।
আর পত্রিকায় যেসব খবর আসে তা অনেক সময় পুরো পরিস্থিতিকে ঠিকভাবে তুলে ধরতে পারে না। প্রকৃত খবর জানে মানুষ, সেই খবর আস্তে আস্তে পুরো জনপদ ঠিকই একদিন জেনে যায়। আর কোনো জনপদের কাছে সেই অভিজ্ঞতাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে পত্রিকারে একটা খবরের থেকে; কারণ আসল পরিস্থিতি তারাই অনুধাবন করতে পারে বা করে। ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের খবর সেই সময় মানুষ যতো না পেয়েছে , পরে আস্তে আস্তে আরো অনেক মর্মান্তিক সব খবর মানুষের গল্পে বেরিয়ে এসেছে। সেই সময়ের সরকার, প্রশাসনের অভাবনীয় গাফলতির কথা সারাদেশের মানুষ অনেক অনেক পরে জানতে পেরেছে। তখন তা জানতেও দেওয়া হয়নি। বর্তমানেও দেখা যায়, সরকার ও প্রশাসন দুর্ঘটনার খবরকে বিকৃত করে উপস্থাপনের মাধ্যমে তাদের দায় এড়াতে চায়। সেটা আগে যেমন ছিলো, এখনো আছে। কেরালাও সম্ভবত এর বাইরে নয়।
দুর্যোগের সময় মৎস্যজীবীরা সবাইকে এক করে। তারা চার্চের ফাদারের মাধ্যমে সবাইকে আহ্বান করে উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়ার। কারণ পানি বাড়লে কীভাবে টিকে থাকা যাবে মৎস্যজীবীদের সেই প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা আছে, কিন্তু সাধারণ জনগণের নেই। তাই তারা না এগিয়ে আসলে কেরালার মানুষই মরবে; যাদের কাছে মাছ বিক্রি করেই তাদের জীবন চলে। ফলে তারা নৌকা নিয়ে বন্যা অধ্যুষিত এলাকায় রওনা দেয়; সেই নৌকা বন্যা কবলিত এলাকায় পৌঁছে দিতে ট্রাক মালিক-শ্রমিকরা তাদের পাশে দাঁড়ায়। এই মিলিত শক্তিতে যারা মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করে, সেই মানুষগুলোই হলো নায়ক, এই সিনেমার নায়ক, এই ঘটনার নায়ক।
তাদের দ্রুত সিদ্ধান্তের কারণে শত শত মানুষ রক্ষা পায়। তারা এটাকে মানুষের সেবা করার সুযোগ হিসেবেই দেখে। যতো দ্রুত বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছিলো, প্রশাসন চাই্লেও ততো দ্রুত সব জায়গায় ব্যবস্থা নিতে পারতো না (অন্তত সেভাবেই দেখানো হয়েছে সিনেমাতে, যদিও এটা বিতর্কিত বিষয়)। সাধারণ জনগণের এই ধরনের উপলব্ধি আর মানুষকে বাঁচানোর ইচ্ছা না থাকলে, কখনোই এতো মানুষ হয়তো বাঁচানো যেতো না। কারণ বাইরে থেকে কেউ এসে এতো দ্রুত কিছু করা কঠিন। তার ওপরে স্থানীয় মানুষের তাদের প্রতি বিশ্বাস-আস্থার ব্যাপার আছে। ফলে নিজেদের মানুষ যখন এগিয়ে আসে, তখন এধরনের কাজ সহজ হয়। মানুষ সহজে তাদের বিশ্বাস করে। সেজন্যই কোনো কমিউনিটিতে প্রতিবেশিকে এতো গুরুত্ব দেওয়া হয়।
রাজধানী ঢাকা শহরে এতো অশান্তির কারণ মনে হয় এই প্রতিবেশি-ই। সেখানে কেউই বলতে গেলে স্থানীয় নয়। সবাই বাইরে থেকে আসা। ফলে দায়িত্ব কেউ নিতে চায় না বা নেওয়া সহজ নয়। অনেকেই জানে না, কে থাকে তার পাশের ফ্ল্যাটে; জানে না কী হচ্ছে এলাকায়; সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত; সম্মিলিত প্রচেষ্টার কোনো চিহ্ন নেই; মানুষে মানুষে নেই যোগাযোগ; বিপদ আপদে বেশিরভাগ সময়ে আশেপাশে পাওয়া যায় না কাউকে। ৯৯৯-এ ফোন করে সাহায্য চাওয়াই যেনো একমাত্র উপায়। যা কখনোই শেষ কথা হওয়ার কথা ছিলো না। অবশ্য এটা দিয়ে সব সমস্যার সমাধানও সম্ভব নয়। মানুষের পারস্পারিক বোঝাপড়া জরুরি।
নয়.
বন্যার কারণে ‘বাঁচাও কেরালা’ (Save Kerala) নামে একটা হোয়াটসআপ গ্রুপ খোলা হয়। যেখানে যারা বিপদে পড়েছে এবং সাহায্য করতে পারবে, সবাই যোগাযোগ করে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির একটা ভালো ব্যবহার দেখানো হয়। প্রশাসন থেকেও সবাইকে এই গ্রুপে যোগ দেওয়ার জন্য বলা হয়। এই উদ্যোগ উদ্ধার কাজকে সহজ করে।
প্রায় আড়াই ঘণ্টার এই সিনেমায় প্রথম এক ঘণ্টা নেওয়া হয় চরিত্রগুলো, তাদের মানসিক অবস্থা, এলাকার সবার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ইত্যাদি তুলে ধরার জন্য। এটা ছাড়া অবশ্য পরের দেড় ঘণ্টার ঘটনা দর্শকের কাছে বোধগম্য হতো না। এই চরিত্রগুলো না চিনে নিলে তাদের অবস্থা, তাদের কষ্ট, ভালোবাসা বোঝা কঠিন হতো।
‘২০১২’ নামে আরেকটি সিনেমা সারা পৃথিবীতে আলোড়ন তুলেছিলো। ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেখানে শেষ পর্যন্ত পুরো পৃথিবী পানিতে ডুবে গিয়েছিলো। সেখানেও চরিত্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক স্টাবলিশ করা হয়েছিলো, যাতে পর্দার মানুষগুলোর অনুভূতিকে দুর্যোগের সময় দর্শক ভাষান্তর করে নিতে পারে। ‘২০১৮’-ও এর ব্যতিক্রম নয়। দুর্যোগ সংক্রান্ত যেকোনো চলচ্চিত্র নির্মাণে এই জায়গাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। না হলে সেটা ঠিক ফিকশন হিসেবে দাঁড়ায় না সহজে।
মানুষে মানুষের সম্পর্কগুলো নতুন করে চেনা যায় দুর্যোগের সময়। মানুষ যে কেনো মানুষ, সেটা আলাদাভাবে বোঝা যায় দুর্যোগের সময়। এক্ষেত্রে কেরালা খানিক আলাদা। উপমহাদেশের সব থেকে শিক্ষিত মানুষের অঞ্চল এটি। যেখানে সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা অন্যান্য জায়গার তুলনায় ভালো। তাদের মধ্যকার কথাবার্তা, কোনো অবস্থাকে নিয়ে ভাবার ব্যাপারগুলো উপমহাদেশের অনেক অঞ্চলের তুলনায় আলাদা।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কতো কতো ঘটনা। সিনেমাতে তার কতোটুকুইবা এসেছে! এতো বছর ধরে সিনেমা হচ্ছে এই দেশে, সেখানে দেশের এই ঘটনাগুলো বলা চলে অবহেলিত। অথচ কতো মানবিক, পাশবিক, হারানোর, পাওয়ার গল্প আছে সেখানে। কেরালার এই সিনেমা এই অঞ্চলের অনেককেই তাদের গল্পটা দেখানোর উৎসাহ দেবে দর্শক-নির্মাতাকে।
বাংলাদেশের দর্শক কি এখনো সেই কথিত হিরোইজমেই আটকে থাকবে; শাকিব খান, শাহরুখ খান নিয়েই পড়ে থাকবে? এই চিন্তার পরিবর্তনের জন্য অন্য দেশের এই ধরনের সিনেমাগুলো যেকোনোভাবে দর্শককে দেখানো জরুরি। টিকে থাকা, সাহস, মানবিকতা, আশা, উৎসাহ, বেঁচে থাকার লড়াই, যেকোনো অবস্থায় সবশেষটুকু দিয়ে নিজেকে, ভালোবাসার মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ের গল্প হলো ‘২০১৮ : এভরিওয়ান ইজ এ হিরো’।
দশ.
‘২০১৮’তে ডকুমেন্টরি ফুটেজের ব্যবহার সিনেমাটিতে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। কেরালার এই ঘটনার সময় অনেক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। তারা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে তাদের পরিবারের ছবিসহ ভিডিও পোস্ট দেয় এবং সাহায্যের আবেদন করে। ইউটিউব, ইন্সটাগ্রামে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে। সিনেমায় এগুলো থেকে নেওয়া বা এরকম কিছু দৃশ্য দেখানো হয়, আবার কিছু দৃশ্য সরাসরি টিভি, মিডিয়া থেকে নিয়েও ফিকশনের মধ্যে দেখানো হয়। এতে সিনেমাটির ন্যারেটিভের সঙ্গে সত্যি ঘটনার সংযোগ আরো দৃঢ়ভাবে ফুটে ওঠে। কাজটা অবশ্য পরিমিতি বোধের সঙ্গেই করা। অনেকটা ডকু-ফিকশনের মতো করে উদ্ধারের জায়গাগুলো দেখানো হয়েছে।
প্রথাগত ইতিহাসে ক্ষমতাবানদের ভীড়ে সাধারণ মানুষের ইতিহাস হারিয়ে যায়। এই জায়গায় ফিকশন শক্তিশালী একটা মাধ্যম। এই সিনেমা দেখার পর অনেকেই হয়তো আলাদা করে পড়বে বা জানতে চাইবে ২০১৮’র আগস্টে কেরালাতে কী দুর্যোগ হয়েছিলো। এবং প্রশাসন ও সাধারণ জনগণ সেটা কীভাবে মোকাবিলা করেছিলো। এই সিনেমাতে যারা কাজ করেছেন তারা তাদের জন্মস্থানের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই হয়তো করেছেন। এই কাজ সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে সিনেমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষদেরকে অনুভূতি এবং সম্মানের জায়গায় তাদের জীবনকালেই হয়তো অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে। এমন প্রত্যাশা করাই যায়।
এগারো.
কেরালার সিনেমায় বৃষ্টি সব সময় একটা জরুরী অংশ। যেহেতু কনটেন্টের ওপর নির্মাতারা বেশি জোর দেন, তাই তারা হয়তো কেরালার সিনেমাই বানাতে চায়, যেখানে কেরালার বৈশিষ্ট্য থাকে, তাদের আবহাওয়া থাকে, তাদের পোশাক থাকে, বার্গার-পিৎজার আগে তাদের খাবারের কথা থাকে, প্যান্ট-শার্টের আগে থাকে তাদের নিজেদের পোশাক, যার নাম ‘মুন্ডু’। এটা দক্ষিণ ভারতেরই একটা আইকনিক পোশাক। লুঙ্গি আর ধুতির মাঝামাঝি জাতীয়। তুলা দিয়ে তৈরি। তাদের পোশাক, চুলের কাট, গোঁফ, পায়ের স্যান্ডেল, কেরালাতে যেমন দেখা যায় তেমনই। তাই সিনেমা দেখেই বলতে কষ্ট হয় না এটা কেরালার সিনেমা।
‘২০১৮’ সিনেমাটা কেরালার সিনেমাই; ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, মারাঠা, নাগাল্যান্ড বা আসামের সিনেমা নয়। আর এভাবে গল্প কেরালার নির্মাতারাই বলেন। তাই এটি কেরালারই সিনেমা।
ভারত থেকে অস্কারে বা বিদেশি পুরস্কারের জন্য সিনেমা পাঠানোর ক্ষেত্রে কি রাজনীতি থাকে? কোনো কিছু না জেনেও বলা যায়, অবশ্যই থাকে। না হলে ‘কেরালা স্টোরি’র মতো সিনেমা কিভাবে টিকে থাকে এই দৌড়ে! রাজনীতি, অর্থ সবই থাকে। ক্যাপিটালের ছোবল থেকে কারো কি মুক্তি আছে?
বারো.
‘২০১৮’ সিনেমাটা যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ এবং যে কারণে এটি ভারতীয় সিনেমা হিসেবে আলাদা, সেটি হলো এই সিনেমার বিষয়বস্তু। বাকি সব কিছুকে যদি আমরা নাও ধরি, শুধু বিষয়বস্তুর জন্য নির্মাতা এবং ওনার পুরো টিমকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়। হলিউডে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে অনেকগুলো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছে।
যারা এই ধরনের দুর্যোগের মুখোমুখি কখনো হয়নি, অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসলে কী জিনিস সেটা জানার ব্যাপারে যাদের কাছে খবরের কাগজ আর টেলিভিশনই একমাত্র উপায়, তাদের ক্ষেত্রে মূল ঘটনার সঙ্গে কতোটুকু সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব সেটা ভাববার বিষয়। সংবাদপত্রে অসংখ্য খারাপ খবর অনুভূতিতে এক ধরনের অসাড়তা তৈরি করে, ফলে যেকোনো ঘটনাই যেনো ‘গা সওয়া ব্যাপার’ হয়ে যায়। যতোক্ষণ না নিজেদের কেউ ভিকটিম বা আক্রান্ত না হয়, নিজেদের সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, ততোক্ষণ পর্যন্ত বিপদকে পুরোপুরি উপলব্ধি করা কঠিন হয়।
‘২০১৮’ সিনেমায় প্রথম এক ঘণ্টা এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন চরিত্রকে দর্শকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়। দর্শক তখন তাদেরকে নিজেদের আশেপাশের মানুষ হিসেবেই চিহ্নিত করতে পারে। বাবা-মায়ের সম্পর্ক, শিশুর সঙ্গে বড়োদের সম্পর্ক, অন্ধ এক দোকানদারের সঙ্গে এলাকাবাসীর সম্পর্ক, স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নতুন শিক্ষিকার আলাপচারিতা, নতুন সব সম্পর্ক গড়ে ওঠা, ইত্যাদি পরিস্থিতির মাধ্যমে দর্শক চরিত্রগুলোর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নেয়। একপর্যায়ে এই মানুষগুলোই কেরালায় ভয়াবহ দুর্যোগে আক্রান্ত হয়, এদের থেকেই কেউ কেউ আক্রান্তদের উদ্ধারে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। এই চেনা মানুষগুলোর বিপদ অন্যদের আক্রান্ত করে। দর্শকও তাদের অনেক কাছে পৌঁছায় বলে মনে হয়। ফলে আমি থেকে আমরাতে পৌঁছানো যায়। এই জায়গায় ‘২০১৮’ একটা জরুরি সিনেমা।
অথচ এ ধরনের বিষয় নিয়ে সিনেমার সংখ্যা খুবই কম। বিশেষ করে আমাদের দেশে। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত ভূমিধস, জলোচ্ছ্বাস হয়, এ নিয়ে সিনেমার সংখ্যা হাতেগোনা। ১৯৭০-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঠিক আগে জলোচ্ছ্বাসের অবস্থা ও প্রভাব নিয়ে কোনো সিনেমা করা যায়নি। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ এবং এর কারণে জনগণের মন মানসিকতায় কী পরিবর্তন এসেছিলো, সেটাকেও পর্দায় আনা যায়নি। অথচ দেশের স্বার্থে, জনগণের সঠিক উপলব্ধির জন্য এবং রাজনৈতিক কারণেই এই বিষয়গুলো নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ জরুরি। সরকারি অর্থায়নে মানে জনগণের টাকায়ও এসব সিনেমা হতে পারে। সেই জায়গা থেকে কেরালা সরকার এবং বিরোধীদলের প্রশংসা করতে হয়। সিনেমাটির পাশে থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কেরালার জনগণের স্বার্থে তারা কাজটাকে সমর্থন দিয়েছেন।
তেরো.
দুর্যোগ নিয়ে একটা সিনেমায় বার বার সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততার কথা বলে, তাদেরকে নায়ক, হিরো করে উপস্থাপনের মধ্যে কি প্রশাসনের গাফিলতি আর অবহেলাকে আড়াল করার চেষ্টা আছে? একটু ভালোভাবে দেখলে উত্তরটা হয়তো ইতিবাচকই হবে। একটা প্রদেশের এতো বড়ো দুর্যোগের ঘটনায় ভারতের মতো বিপুল পুঁজির দেশ কতোটুকু সামলাতে পারলো সেটা নিয়ে কিন্তু বিতর্ক আছে। প্রাদেশিক সরকারও কি যথেষ্ট দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলো, নাকি আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সিদ্ধান্তহীনতা ছিলো?
যেহেতু আবহওয়া সংক্রান্ত এই ধরনের দুর্যোগ প্রায় প্রতি বছরই কমবেশি হয়, তাই সরকার ও বিরোধী দল এক সুরে কথা বলবে সেটাই স্বাভাবিক। কারণ প্রচলিত রাজনীতিতে দুই পক্ষই তো ক্ষমতার এপিঠ-ওপিঠ। ট্যাক্সের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার যে আয়োজন, যেখানে শত লোক চাকরি করে; তাহলে তারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারে না কেনো! ফলে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার সেরা উপায় হলো জনগণকে ‘হিরো’ অ্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের গা বাঁচানো, দেখো ওরাই আসল হিরো।
তাই ‘২০১৮’ সিনেমাটিকে শুধু সিনেমা হিসেবে দেখলে হবে না। এইটা প্রোপাগান্ডারই অংশ কিনা, সেটাও সিনেমাটি দেখার সময় খেয়াল রাখা জরুরি। প্রশাসনের ব্যর্থতা কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো গাফিলতির কোনো অবস্থা সিনেমায় চোখে পড়ে না। তার পরও সিনেমা সিনেমা হিসেবে ‘২০১৮ : এভরিওয়ান ইজ এ হিরো’ অত্যন্ত জরুরি। সব মিলিয়ে এই সিনেমা যেমন অনেক কিছু দেখায়, একই সঙ্গে অনেক অদেখা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। আর এখানেই হয়তো ‘২০১৮ : এভরিওয়ান ইজ এ হিরো’ গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : আসিফ রহমান সৈকত, চলচ্চিত্র কর্মী, নির্মাতা ও লেখক।
saikatfpdu@gmail.com
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন