মাহমুদুল হাসান
প্রকাশিত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
প্রেম-অপ্রেম-রাজনীতি-দর্শন, অস্তিত্ব আর শিল্প ভাবনায় গদার
মাহমুদুল হাসান
ভূমিকা
জ্যঁ ককতো একবার বলেছিলেন, ‘Know that your work speaks only to those on the same wavelength as you.’। এই কথার রেশ ধরেই মনে পড়ে অশীতিপর রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘জন্মদিন’ কাব্যগ্রন্থের ‘ঐকতান’ কবিতাটি ও তার সহজ স্বীকারোক্তি—‘তাই আমি মেনে নিই সে নিন্দার কথা, আমার সুরের অপূর্ণতা। আমার কবিতা, জানি আমি, গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।’ কথাগুলো যদিও একেবারেই তাদের ব্যক্তিক বোঝাপড়ার ফল তবুও তাদের এই কথা হয়তো সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেনো জানি মনে হয়, কোনো কোনো ব্যক্তিত্ব এই বৃত্তের বাইরে থেকে যায় বরাবরই। তেমনই একজন জ্যঁ লুক গদার। জীবদ্দশায় ১৩২টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন গদার। কাজের পরিসর গুনে, দেখে, পাঠ করে তাকে হয়তো সেই কাতারে ফেলতে চাইবে না কেউই, যেমনটা ফেলা যায় না নিজের অপূর্ণতা অকপটে স্বীকার করা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও। তবুও তো অপূর্ণতাটা থেকে যায়! কিন্তু গদার! নিজের কোনো অপূর্ণতাকেই স্বীকার করেননি তিনি। কেনোইবা করবেন!
চলচ্চিত্র যুগের শুরুতে সাদা-কালো থেকে শুরু করে হাল আমলের থ্রি ডি কী নেই তার নির্মাণে! মানুষ মরলে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়, কিন্তু গদার তার উল্টো। প্রথাবিরোধী। পৃথিবীকেই বরং অসহায় হয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিতে দেখা যায়। তিনি নিজেই হয়ে ওঠেন আরেক পৃথিবী; তাই তো অকপটে আলিঙ্গন করতে পারেন ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’। ‘মানুষ জন্ম নিলে মৃত্যু অবধারিত’ কথাটা এসে নতজানু হয়ে সেলাম জানায় তার পদতলে, হার মানে! নীলকণ্ঠ রূপ ধারণ করে মৃত্যু নামক বিষকে গলায় চেপে দারুণ এক ভৈরবী তাণ্ডব নৃত্যে মেতে ওঠেন গদার। মৃত্যু যেনো তার হাতের পুতুল! যাকে ইচ্ছে মতো ভাঙা যায়, গড়া যায়! কাজী নজরুলের সেই বাণীর মতো— ‘আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা’। গদারও যেনো মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জাই ধরলেন! মৃত্যু তখন যেনো তাকে আরো জীবন্ত করে তোলে! তখন আনমনেই সুকান্ত’র ‘দুরাশার মৃত্যু’ কবিতাখানির কয়েকটা লাইন মনে পড়ে—‘দ্বারে মৃত্যু, বনে বনে লেগেছে জোয়ার, পিছনে কি পথ নেই আর? আমাদের এই পলায়ন জেনেছে মরণ, অনুগামী ধূর্ত পিছে পিছে, প্রস্থানের চেষ্টা হল মিছে।’ তখন প্রশ্ন জাগে মনে, সত্যিই কি গদার প্রস্থান করলেন! নাকি তীব্রভাবে হাজির থেকে গেলেন বর্তমানতায়!
অনেকেই আপত্তি তোলে গদার নাকি দুর্বোধ্য। সহজেই ধরা দেন না। তারে দেখা যায়, ছোঁয়া যায় না। তার কথাতে যদিও সেটার নজিরও পাওয়া যায় কিছুটা। তিনি বলেন, `I don’t make film for the masses but through the masses.’। তখন তার চলচ্চিত্র ‘দুর্বোধ্য’ই হয়ে ওঠে বটে। তার চলচ্চিত্র বোঝার জন্য ‘নির্মাতা’, ‘দর্শক’, ‘পাঠক’ হয়ে উঠতে হয়! মনে পড়ে আডিও গদার (Goodbye Godard, ২০২২) চলচ্চিত্রের আনন্দ চরিত্রটির কথা। উড়িষ্যার প্রান্তিক কোনো এক গ্রামের পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত বৃদ্ধ আনন্দ বন্ধুবান্ধব নিয়ে ডিভিডিতে রোজ পর্নোগ্রাফি দেখেন। হঠাৎ একদিন ভুল করে পর্নোগ্রাফির সিডি আনতে গিয়ে নিয়ে আসেন গদারের ব্রেথলেস (১৯৬০)। সবটা না বুঝলেও আনন্দ অন্তত এটুকু বুঝে যান, নির্মাতা নতুন কিছু করতে চেয়েছেন। তাই মন্তব্য করে বসেন, ‘ডাইরেক্টর নতুন কিছু করতে চাইছে মনে হয়!’ সাঙ্গপাঙ্গরা ক্ষেপে গিয়ে আনন্দকে ইচ্ছেমতো ঝাড়ে—‘এইটা ফিলিম! গান নাই, নাচ নাই, ফাইটিং সিন নাই, প্রেম-পিরিতি কিচ্ছু নাই, আর এইটা ফিলিম!’ সাঙ্গপাঙ্গদের ঝাড়ির উত্তরে আনন্দ বোধ করি তার জীবনের সেরা উক্তিটি করে বসেন, ‘এর জন্যই এইটা ফিলিম’। সেই শুরু! মাথায় জেঁকে বসেন গদার। এরপর একে একে দেখতে থাকেন গদারের চলচ্চিত্র! এর পর গ্রামেই গদারের চলচ্চিত্রের ওপর আয়োজন করে বসেন ফিল্ম ফেস্টিভাল ‘গদার রেট্রোস্পেকটিভ’! পুরো প্রক্রিয়াটাকে খুব বেশি কঠিন বলে মনে হয় না কেনো জানি! কারণটা এই যে, গদার বুঝতে গেলে ‘নির্মাতা’, ‘দর্শক’ কিংবা ‘পাঠক’ হয়ে উঠতে হয়! আনন্দ পেরেছেন একজন প্রান্তিক গ্রামের শ্রমজীবী হয়েও গদারের ‘নির্মাতা’, ‘দর্শক’ কিংবা ‘পাঠক’ হয়ে উঠতে। গদারও বোধ হয় এইটাই চেয়েছিলেন আজীবন!
চলচ্চিত্রাকাশে গদার নক্ষত্রের উদয়
ইউরোপীয় আলোকায়নের (Enlightenment) দাবি, মানুষ এই প্রকল্পের পর থেকে দিনকে দিন ‘সভ্য’ থেকে ‘সভ্যতর’ হয়ে উঠেছে। কিন্তু সেই ‘সভ্যতা’রই নমুনা হিসেবে যখন দুটো বিশ্বযুদ্ধ হয়; যেখানে উঠে আসে মানুষের দুর্বিষহ আর্তনাদ, মানুষ মানুষকেই মারণাস্ত্র আর অ্যাটোম বোমার আঘাতে করে ছিন্নভিন্ন, তখন সেটাকে অস্বীকার করতেও দ্বিধা কাজ করে না! সেই অস্বীকৃতিকে আধার করেই বব ডিলান রচনা করেছিলেন তার ‘Blowin’ in the wind’ নামে অমর গানখানা। যা আজও যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোকে প্রেষণা যোগায় রোজ। কিংবা যে ‘সভ্যতার অধঃপতন’ দেখা যায় তাতে স্বয়ং মানুষেরই অস্তিত্ব হয়ে ওঠে সঙ্কটাপন্ন। তাহলে কোন ‘সভ্যতা’র কথা মুখবোলা টিয়া পাখির মতো আওড়ানো হলো এযাবৎ! প্রশ্ন জাগে! উত্তর না মিললেও কিছুটা কাছাকাছি জায়গায় দাঁড়িয়ে লিওনার্ড কোহেন জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেন তার ‘What Happens to the Heart’ কবিতায়। তিনি বলতে চাইলেন, মানুষই আজ সবচেয়ে বড়ো অমানুষ! সে আজ তার নিজ সত্তা থেকেই বিচ্ছিন্ন। সত্তার এই বিচ্ছিন্নতা ও হাহাকারকে জোর গলায় প্রকাশ করতেই উদ্ভব হয় বিভিন্ন শিল্পান্দোলনের—ইম্প্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম, সুররিয়ালিজম। শিল্পী তার প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে না পেয়ে উলঙ্গ হয়ে রাস্তায় নামে, চিৎকার করে! উলঙ্গ হওয়া কিংবা চিৎকার হয়ে ওঠে শিল্পীর ভাষা! কারণ প্রতিবাদের যে কথ্য ভাষা তা সে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে! শিল্পীর উলঙ্গ হওয়া কিংবা চিৎকার যেনো প্রচলিত অসহনীয় রীতি-নীতিগুলোর গোড়ায় কঠোর কুঠারাঘাত করে!
সময়টা তখন ছিলো অন্ধকারাচ্ছন্ন। কারণ কেবল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। চারিদিকে হাহাকার আর আর্তনাদ! হিটলারের পরাজয়ে ফ্রান্স হয়ে পড়েছে আমেরিকার অধীন। ফ্রান্সের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে হলিউড চলচ্চিত্রের জয়জয়কার! সঙ্গে নিজেদের সেই কাঠামোবদ্ধ ন্যারেটিভের চলচ্চিত্র। সবমিলিয়ে মানুষ যেমন তার নিজ অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগতে থাকে তেমনই ফ্রান্স ভুগতে থাকে সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব সঙ্কটে। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে; ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ফ্রান্স ও আমেরিকার মধ্যে ‘Blum-Byrnes Accord’ নামে একটা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। সেখানে বলা হয়, আমেরিকা ফ্রান্সকে বিভিন্ন বিষয়ে অর্থনৈতিক সাহায্য করবে; সেইসঙ্গে ফ্রান্সের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়, প্রত্যেক ১৩ সপ্তাহের চার সপ্তাহ ফ্রান্সের প্রতিটি প্রেক্ষাগৃহে বাধ্যতামূলকভাবে ফরাসি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকতে হবে! বিস্ময়কর, একই সঙ্গে দুঃখ জাগানিয়া বিষয় হলো, ওই সময়ে নিজের দেশে নিজের চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতেও আইন করতে হয়েছে ফ্রান্সকে! কাজেই এটা ভাববার অবকাশ রাখে না যে, এই আইন ফ্রান্সের জন্য কতোটা দাসত্বের! সেই সময়ে ফ্রান্সের কমিউনিস্ট মতাদর্শী পত্রিকা ‘L’Humanite’ মন্তব্য করতে বাধ্য হয়—‘The Franco-American Accords Condemn the French Cinema to Death.’!
ঠিক সেই সময় আলোকবর্তিকা হাতে ভ্যানগার্ডের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় আঁদ্রে বাঁযা’র চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা ‘কাইয়্যে দ্যু সিনেমা’ (Cahiers du Cinema)। নিজেদের কাঠামোবদ্ধ ন্যারেটিভের চলচ্চিত্র ও হলিউডি ডিসকোর্সের বাইরে দাঁড়িয়ে ‘কাইয়্যে দ্যু সিনেমা’কে প্রথাগত চলচ্চিত্রের তীব্র সমালোচনা করতে দেখা যায়। আঁদ্রে বাঁযা ছাড়াও পত্রিকাটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলো ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, এরিখ রোমার, ক্লদ শ্যাব্রল, জ্যঁ লুক গদার প্রমুখ। একপর্যায়ে সমালোচনার পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকেও দৃষ্টি পড়ে তাদের। চলচ্চিত্রের নতুন ছবিভাষা গোচরীভূত হতে থাকে। চলচ্চিত্র নিয়ে চলতে থাকে নানা নিরীক্ষণ, তত্ত্বায়ন। চলচ্চিত্রের সেই সব নিরীক্ষণ, তত্ত্বায়নের নমুনাস্বরূপ ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো’র হাত ধরেই দেখা যায় ‘অত্যর তত্ত্বে’র (Auteur Theory) উদ্ভব ও বিবর্তন এবং গদারের হাতে তার পরিপূর্ণতা। যেখানে একজন নির্মাতা ক্যামেরাকে ব্যবহার করে কলম হিসেবে। সেখান থেকেই উদ্ভব ‘লা ক্যামেরা স্টাইলো’র (La Camera Stylo)। যদিও গদার চলচ্চিত্র নির্মাণ ও সমালোচনার মধ্যে কোনো তফাৎ দেখেননি! কারণ হিসেবে বলেছেন,
Writing was already a way of making films, for the difference between writing and directing is quantitative not qualitative. … As a critic, I thought of myself as a film-maker. Today I still think of myself as a critic, and in a sense I am, more than ever before. Instead of writing criticism, I make a film, but the critical dimension is subsumed. I think of myself as an essayist, producing essays in novel form or novels in essay form: only instead of writing, I film them.১
এছাড়া গদার হয়তো তফাৎ দেখেননি এ কারণেই যে, একজন নির্মাতা যে দর্শন বা বোঝাপড়ার ওপর ভর করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন দর্শক বা পাঠক সেই চলচ্চিত্র দেখতে বসে নিজের মতো করে দেখে, নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দাঁড় করায় বা সমালোচনা করে। কাজেই এই জায়গা থেকে দর্শক বা পাঠকের চলচ্চিত্র দেখা ও সমালোচনা আরো একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের সামিলই হয়ে ওঠে! এই পাটাতনে দাঁড়িয়ে গদারের চিন্তাকে উত্তরাধুনিক ভাবতেও কুণ্ঠাবোধ হয় না! যদিও তিনি প্রথম দিকে ছিলেন অস্তিত্ববাদে প্রভাবিত। যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীর ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে ‘Being and Nothingness’ গ্রন্থে ফরাসি দার্শনিক জ্যঁ পল সার্ত্রে দারুণ রকম অস্তিত্ব সঙ্কটে ভোগা মানুষের অস্তিত্বকে তার ইতিহাসের বীজে খুঁজতে চেয়েছেন। আর সেই দর্শন গদারকে কেবল মুগ্ধই করেনি, তার ললাটে এঁকে দিয়েছিলো ত্রিনয়ন! গদার তার এক সাক্ষাৎকারে সেটা সরাসরি স্বীকারও করেছেন। তিনি বলেন, ‘Through Sartre I discovered literature, and he led me to everything else.’।
যাইহোক ‘কাইয়্যে দ্যু সিনেমা’র এইসব নিরীক্ষণ ও তত্ত্বায়নের ওপর দাঁড়িয়ে ফরাসি চলচ্চিত্রের বাঁকবদল ঘটে। ফরাসি চলচ্চিত্রের ঘাটে বানের জোয়ার ডেকে যায়! যার নাম ‘লা নুভেল ভাগ’ (La Nouvelle Vague)। আর এই জোয়ারে নতুন করে তরী ভাসান জ্যঁ লুক গদার তার প্রথম চলচ্চিত্র ব্রেথলেসকে বৈঠা করে!
গদারের হাতে ফরাসি চলচ্চিত্রের পটপরিবর্তন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইতালিতে এর আগেই জন্ম নেয় ইতালিয় নব্য চলচ্চিত্রধারা ‘নিউরিয়ালিজম’। ভীষণরকম রাজনৈতিক অস্থিরতার অন্তরালেই এর জন্ম। এ ধারার সূচনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে। এবং মধ্য ৪০-এর দশক থেকে রসোলিনি, ভিত্তোরিও ডি সিকা প্রমুখ এই ধারার বিকাশ ঘটিয়েছে। বলা হয়ে থাকে ফরাসি নুভেল ভাগের ওপর নিউরিয়ালিজমের প্রভাব রয়েছে। তবে একে পুরো নিউরিয়ালিজম বললে ভুল হবে। কারণ নুভেল ভাগ গড়ে উঠেছিলো অবশ্যই ফ্রান্সের তৎকালীন সমাজ-বাস্তবতা, রাজনীতি, পরিবেশ, পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে। কাজেই ইতালীয় নিউরিয়ালিজমের প্রভাব থাকলেও নুভেল ভাগ পুরোপুরি ফ্রান্সীয়।
ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ (১৯৫৯) বলতে গেলে হয়ে উঠেছিলো নুভেল ভাগের সংজ্ঞা নির্ধারণকারী প্রথম চলচ্চিত্র। সেটাকেই পরিপূর্ণতা দেয় গদারের ব্রেথলেস (১৯৬০)। ত্রুফো একবার বলেছিলেন, দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ-এর আন্তোনিও ড্যানিয়েলই বড়ো হয়ে হয়েছে মিশেল পয়কার্ড (ব্রেথলেস)। কিংবা ফরাসি এক চলচ্চিত্র সমালোচকের ভাষায়, ‘If The 400 Blows was the February revolution, Breathless was October.’। তবে ব্রেথলেসকে কেনো জানি দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ-এর সিক্যুয়াল ভাবতে ইচ্ছা করে না। কারণ ব্রেথলেস দারুণভাবে গদারীয়! কেবল ব্রেথলেস নয়, গদার নিজেই গদারীয়! তার চলচ্চিত্রে সঙ্গীতের বেলায় বেটোফোন, মোৎজার্ট; সাহিত্যের ক্ষেত্রে জার্মান কবি বের্টল্ট ব্রেখট আর দর্শনগত জায়গা থেকে কিয়ের্কেগার্ড, নীৎশে থেকে শুরু করে জ্যঁ পল সার্ত্রে প্রমুখ নানাভাবে এসেছে। তবে তাদের উপস্থাপনও ছিলো গদারীয়! দার্শনিক তার দর্শনকে ‘Epistemologically’ হাজির করলেও ভিজ্যুয়ালে সেই দর্শনের ‘Ontological’ বা সত্তাতাত্ত্বিক রিপ্রেজেন্টেশন দেখতে পাই। মানে চলচ্চিত্রকে ‘Philosophical Experiment' বলা যেতে পারে, সেটা দারুণভাবে ফুটে ওঠে গদারের চলচ্চিত্রে।
গদারের প্রথম দিকের, বিশেষ করে ৬০-৭০ দশকের চলচ্চিত্রগুলোর বেশিরভাগই ছিলো অস্তিত্ববাদ তাড়িত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিপর্যস্ত মানবসত্তা নিয়ে সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিসরে এক দারুণ আলোড়ন তৈরি করেছিলো! সাড়া ফেলেছিলো চিন্তার জগতে। সবকিছুর মূলে যে মানুষ, সেই মানুষকেই যখন নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, তখন সেই পাটাতনে দাঁড়িয়ে সার্ত্রেসহ আরো কয়েকজন দার্শনিক আওয়াজ তুলেছিলো। গদারের ব্রেথলেস ও আলফাভিল-এ সেই ছোঁয়া রয়েছে। ব্রেথলেস-এ গদার দেখান মৃত্যু ভাবনায় তাড়িত বেপরোয়া যুবক মিশেল পয়কার্ডকে। মিশেলের মৃত্যুভাবনাকে কেবল তারই নয় বরং সেই সময়ের দমবন্ধ পরিস্থিতিতে পুরো মানবসত্তার এক বিপন্ন অস্তিত্ব ও মৃত্যুভাবনা হিসেবে পাঠ করা যায়। শেষ দৃশ্যে মিশেল মারা গেলেও যে জীবন তিনি যাপন করতেন, তার মধ্যেই থেকে যায় মানবমুক্তির দিশা। যা তার প্রেমিকা প্যাট্রিসিয়া নিজ জীবনাদর্শ হিসেবে নির্মোহে ধারণ করতে চান। তখন সেটা মিশেলের জীবনের জয়গান হয়ে ওঠে কিনা বলা মুশকিল; তবে মিশেলের জীবনের এক্সটেনশন হয়ে ওঠে নিশ্চয়ই!
অন্যদিকে আলফাভিল শেষ হয় নাতাশা ভন ব্রাউন-এর সংলাপ ‘I’m the Time. I’m me Alpha-60’ দিয়ে। আলফাভিল শহরের সব ধরনের যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে নাতাশার এই বয়ান যেনো মানব সভ্যতার অস্তিত্বকেই জানান দেয়। যান্ত্রিক শহর আলফাভিলকে এই বক্তব্যের মাধ্যমে যেনো মানবিকীকরণ করা হয়। ধীরে ধীরে পৃথিবী যে যান্ত্রিকতার পথ ধরে হাঁটছে তার বিরুদ্ধেই নাতাশার উচ্চারিত লাইনটি হয়ে থাকে অমর কাব্যের মতো! যা মানুষকে সব ধরনের যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়তে প্রেরণা জোগায়। যেমনটা সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ সেই সময়টাকে ধরে মানব সমাজের দ্বন্দ্ব, সংঘাত, অস্তিত্বহীনতাকে ব্যাখ্যার মাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছিলো মানবমনে। গদারও তেমনই সেই সময়টাতে মানুষের যান্ত্রিকতার বাড়াবাড়ির সঙ্গে সঙ্গে ‘আমি’টাকে ভুলে যাওয়ার প্রবণতাকেই সেলুলয়েডে উপস্থাপন করেন, সেইসঙ্গে ঘটান ফরাসি চলচ্চিত্রের বাঁকবদলও।
বন্দুক আর নারীর দর্শন
গদার বলেন, ‘All you need to make a movie is a girl and a gun.’। এই বক্তব্যে গদারকে অনেকখানি ধরতে পারা যায়। এ বক্তব্যের ভারই গদার আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন, করেছেন প্রচারও। শোনা যায়, শিল্প বাধাগ্রস্থ না হলে নাকি ঠিকরে বেরুতে পারে না। গদারের বন্দুক আর নারীর দর্শন অনেকটা তারই প্রতিধ্বনি বলে মনে হয়!
গদার কী দারুণ করে সেই সময়টাকে ধরে ফেললেন মাত্র একটা বাক্যে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তো একরকম নাটকীয়তা নিয়েই হাজির হয়েছিলো। সেটাকে ‘সিনেমা’ না বলে আর কীইবা বলা যেতে পারতো! যে ‘সিনেমা’য় প্রোটাগনিস্ট বা সাবজেক্ট হলো বন্দুক, মারণাস্ত্র আর অবজেক্ট হয়ে উঠেছিলো মানুষ। গদার যে সময়টাতে বৌদ্ধিক দিক থেকে পাকাপোক্ত হয়ে উঠছিলেন, ঠিক সেই সময়েই বন্দুকের রমরমা আধিপত্য। কাজেই বন্দুক তার মানসে অনেক বড়ো একটা উপাদান হিসেবে ছিলো বলাই চলে। কিন্তু চলচ্চিত্রে সেই বন্দুকের ব্যবহার গদার কীভাবে করেছেন সেটাই দেখবার বিষয়।
গদার তার প্রায় সবগুলো চলচ্চিত্রেই বন্দুকের অবাধ ব্যবহার করেছেন। মাঝে মাঝে যেনো বন্দুকই আলাদা করে একটা ক্যারেক্টার হয়ে ওঠে! ব্রেথলেস-এ মিশেল পয়কার্ড ছন্নছাড়া এক নিহিলিস্ট যুবক। যিনি কিনা ধর্ম ও নিহিলিজমকেও উতরিয়ে যেতে চান। ঠিক তখনই মিশেল হয়ে ওঠে নীৎশের ‘Overman’২-এর প্রতিভূ। প্রথম দৃশ্যে একটা গাড়ি চুরি করে পালানোর সময়ে একটা পিস্তল উপরি হিসেবে জুটে যায় তার নসিবে। পরে সেই পিস্তলটাই যেনো আলাদা করে একটা চরিত্র হয়ে ওঠে। সঙ্গহীন জীবনে এক ‘বিশ্বস্ত’ সঙ্গী জুটলো যেনো! এরপরের দৃশ্যেই দেখা যায় গাড়ির গতি বেড়ে গেছে। বেপরোয়াভাবে চলছে গাড়ি। মনে হয় পিস্তলটাই মিশেলের জীবনের সব, যা জীবনের গতি বাড়াতেও পারে, কমিয়ে শূন্যের কোটায়ও নামিয়ে আনতে পারে। পিস্তলই হয়ে ওঠে তার জীবনের সেফগার্ড। অথচ সেই পিস্তলের গুলিতেই তার মতো হাজারো মিশেলকে জীবন দিতে হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে!
একই ধরনের চিন্তার প্রবাহমানতা দেখা যায় তার বন্ধুবর ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর মধ্যেও; বৌদ্ধিক জায়গাতেও তারা বন্ধু ছিলেন বলেই হয়তো! তা না হলে জুলস অ্যান্ড জিম (১৯৬২)-এ ত্রুফো একই কথা বলিয়ে নিতেন না ‘Your breasts are the bomb that I like most.’। তখন তাদের এই দর্শনকে একই ডুরিতে বাঁধতে খুব বেশি কষ্ট হয় না। যদিও একটা সময়ে গিয়ে তাদের সেই ঐক্যটা আর লক্ষ করা যায়নি।
অন্য সব জায়গাতে ছাড় পেলেও নারী ভাবনায় গদারের সমালোচনা করা যায়। একটু সূক্ষ্মদৃষ্টিতে তাকালেই দেখা যাবে গদারের চলচ্চিত্রগুলো নারীকেন্দ্রীক, বিশেষ করে যৌনতাকেন্দ্রীক। এবং এই যৌনতার উপস্থাপনায় নারীকে বরাবরই অধীনস্ত এক সত্তা বলে মনে হয়। গদারের নারী ভাবনার সঙ্গে নীৎশের কিছুটা মিল পাওয়া যেতে পারে। আলফাভিল শুরু হয় লেমি কশান (প্রোটাগনিস্ট)-এর একটা হোটেলে থাকবার বন্দোবস্তের দৃশ্য দিয়ে। যিনি পেশায় গুপ্তচর। তাকে হোটেলের কক্ষ দেখিয়ে দেন একজন নারী (বিট্রেস), যিনি টাকার বিনিময়ে তার সঙ্গে শুতে পর্যন্ত রাজি। কশান কক্ষের বাথরুমে গোসল করতে যান, তখন ওই নারীকে বলতে শোনা যায়, ‘চাইলে আমি আপনার সঙ্গে গোসলও করতে পারি, স্যার।’ কশান তখন ওই নারীকে ‘শোনো, ডল, আমি সাবালক। তাই তার কোনো দরকার নেই’বলে বাইরে বেরিয়ে যেতে বলেন। এই দৃশ্যে গদার একজন যৌনকর্মীকে দেখান, কিন্তু কেনো তিনি তার শরীর বিক্রি করেন তা পুরোপুরিই অনুপস্থিত রাখেন চলচ্চিত্রজুড়ে। এইসব দৃশ্যের মাধ্যমে গদার হয়তো সেই সময়ের ফ্রান্সে দ্রুত হারে বাড়তে থাকা যৌনবৃত্তিকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন। কিন্তু তার উপস্থাপনায় পুরুষালি দৃষ্টিভঙ্গি ও নারীর অধঃস্তনতাটা থেকেই যায়! ফ্রিডরিখ নীৎশে যেমন তার ‘Thus Spoke Zarathustra’ বইয়ের ‘On Little Women Old and Young’ অধ্যায়ে বলেছেন, ‘You go to women? Do not forget the whip!’। খেয়াল করবার বিষয়, নীৎশে একজন অভিজ্ঞ বৃদ্ধ নারীকে দিয়েই এই কথাটা বলিয়ে নিচ্ছেন! নারী নিজেই যে এই ধরনের মানসিকতা পোষণ করে সেটারও কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় নীৎশের বক্তব্যে। গদারের নারী দর্শনেও সেই প্রবণতাটা রয়েছে। গদারের নারী যখন বলেন, ‘চাইলে আমি আপনার সঙ্গে গোসলও করতে পারি, স্যার।’ তখন নারীর চৈতন্য নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নারীর এই ধরনের চৈতন্য তৈরিতে পুরুষালি সমাজের প্রভুত্ববাদী ভূমিকা নিয়েও ভাবনাচিন্তার অবকাশ থেকে যায়। গদার সেই অবকাশ নিয়ে ভাবনাচিন্তার ফুরসতটুকুও পান না!
বিট্রেসের সঙ্গে আলাপচারিতা চলছে, এমন সময়েই কশানকে এক গুপ্তচর আক্রমণ করে বসেন, যদিও কশানের গুলির তোপে তিনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এই পরিস্থিতিতে কশানের সন্দেহের তালিকায় পড়ে যান বিট্রেস। সামনের চেয়ারে বসিয়ে বিট্রেসকে শুয়ে থাকা উলঙ্গ এক নারীর পোর্ট্রটে হাতে নিয়ে মাথার উপর উঁচু করে ধরতে বলেন কশান। বিছানায় শুয়ে আছেন সেই নারী। সুডৌল স্তনযুগল। কশানের ভাষায়, বিট্রেস যেমন একজন ‘Seductress’, পোর্ট্রেটের ওই নারীও যেনো আরো বেশি করে সেই গুণাবলি নিয়ে হাজির হন পর্দায়। নারীর রিপ্রেজেন্টেশন হয়ে ওঠে ওই পোর্ট্রেট। কশান তখন তাচ্ছিল্যের মনোভঙ্গি নিয়ে পোর্ট্রেেটর ওই নারীর স্তনযুগল গুলি করে ফুটো করেন এবং একপর্যায়ে বিট্রেসকে জোরপূর্বক কক্ষ থেকে বের করে দেন। নীৎশের কাছে নারী ‘বিপজ্জনক জীব’ সেইসঙ্গে পুরুষের ‘খেলার উপকরণ’ও বটে। নীৎশে তার ‘Thus Spoke Zarathustra’ বইয়ের ‘On Little Women Old and Young’ অধ্যায়েই বলছেন, ‘Two things the real man wants: danger and play. That is why he wants woman as the most dangerous plaything.’। গদারের কাছেও নারী যেনো ঠিক তাই হয়ে ওঠে। আর এ কারণেই কশান হয়তো নারীর স্তনযুগল ফুটো করেন গুলি করে! প্রতিহত করেন ‘বিপদ’কে! সেইসঙ্গে নারী যেহেতু ‘খেলার উপকরণ’, তাই তাকে নিয়ে একটু ‘খেলেন’ও! এজন্য নারীকে ‘চালাক’ এবং ‘সমঝদার’ও হওয়া চাই, তা না হলে ‘Real man’-এর নারীকে নিয়ে ‘খেলা’টা ‘জমবে কী করে!
ব্রেথলেস-এ প্যাট্রিসিয়াকে পুরোদস্তুর ‘ছলনাময়ী’হিসেবে উপস্থাপন করেন গদার। শেষ দৃশ্যে প্যাট্রিসিয়া মিশেলকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেন। মারা যাওয়ার আগে মিশেলের মুখে একটি মাত্র ফরাসি শব্দই শোনা যায়, ‘Degueulasse’। যার অর্থ দাঁড়ায় ‘বিরক্তিকর’, ‘বমি উদ্রেককারী’ ইত্যাদি। নীৎশের সেই কাঙ্ক্ষিত ‘Overman’ মৃত্যুবরণ করছেন একজন নারীর ছলনায় পড়ে! গদারের ওপর যেহেতু নীৎশের প্রভাব রয়েছে, তাই তার নারীর উপস্থাপনায়ও সেই রেশ থেকে যায়। যদিও গদার নীৎশে থেকেও সরে আসেন এই দৃশ্য দিয়েই। মিশেল যখন ‘Degueulasse’ শব্দটা উচ্চারণ করেন, তখন প্যাট্রিসিয়া সেটা ঠিকঠাক বুঝতে না পেরে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশকে জিজ্ঞেস করেন, মিশেল আসলে কী বলছেন? পুলিশ তাকে বুঝিয়ে বলেন। তখন প্যাট্রিসিয়া মিশেলের করা অঙ্গভঙ্গি নকল করে দেখান এবং দর্শকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছোঁড়েন, “What’s that mean `degueulasse’?”। এটা বলে প্যাট্রিসিয়া দৃঢ়চিত্তে পেছন ফিরে চলে যেতে থাকেন। আর এখানেই শেষ হয় ব্রেথলেস। নীৎশের নারী ‘অতিমানবী’ হতে পারে না। গদার এখানেই নীৎশেকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন—পুরুষ পারলে নারী কেনো পারবে না! মিশেলের অঙ্গভঙ্গির নকল এবং দর্শকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছোঁড়ার মধ্য দিয়ে গদার যেনো নারীকেও সেই স্থানে বসাতে চান!
গদারে অস্তিত্ব, অস্তিত্বে গদার
সার্ত্রে তার ‘Being and Nothingness’ গ্রন্থ শুরুই করেছেন উনিশ শতকের ‘আধুনিক সামাজ’ ও এর চিন্তার পরিসরে সত্তার বিভক্তি বা বিভাজন নিয়ে প্রশ্ন তুলে। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আধুনিক সমাজ’ ও এর চিন্তা, সত্তার বিভক্তি বা বিভাজনকে কতোটকু রোধ করতে পারলো? এক্ষেত্রে মানুষ কতোটুকু সফল? (অবশ্যই পর পর সংঘটিত দুটো বিশ্বযুদ্ধকে আমলে নিয়ে) তিনি প্রশ্ন করছেন,
MODERN thought has realized considerable progress by reducing the existent to the series of appearances which manifest it. Its aim was to overcome a certain number of dualisms which have embarrassed philosophy and to replace them by the monism of the phenomenon. Has the attempt been successful?৩
মানুষ অনবরত যন্ত্রের মতো ধেয়ে চলছে সামনের দিকে। গন্তব্যটাই হয়তো জানে না! কিন্তু মানুষ তীব্র বেগে ছুটে চলে কীসের তাড়নায়? সার্ত্রের জবাব, ‘Desire'। ‘Desire' এর উৎস ঘাঁটা আপাতত কাজ নয়। এই ‘Desire' বা বাসনা মানুষকে তার সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে। ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত মানুষ ভবিষ্যতকেই তার আলটিমেট লক্ষ্য ভাবতে থাকে। অর্থাৎ সার্ত্রের ভাষায়, সত্তা তার ‘Being-in-itself' (সত্তার নিজস্ব বা অনড় রূপ) কে ছাড়িয়ে ‘Being-in-itself' (কল্পিত বা ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষিত সত্তা) এর কথা ভাবতে থাকে। কিন্তু মানুষ কখনোই তার আলটিমেট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। সত্তা প্রতিনিয়ত Transcendence বা অতিক্রমণের মধ্য দিয়ে যায়। যেটাকে সার্ত্রে বলছেন, ‘Transcendental Ego' বা ‘The Transcendence of the Ego'। অর্থাৎ কোনো একটা লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর আবার আরেকটা লক্ষ্য তৈরি হয়। এভাবেই মানুষ ভবিষ্যৎ আর লক্ষ্যের ফাঁদে অনবরত ঘুরতে থাকে। আর অনবরত ঘূর্ণন তার মধ্যে ‘ঊনভাব’বা ‘শূন্যতা’তৈরি করে, যেটা সার্ত্রের ভাষায় ‘Nothingness’। আর এ কারণেই তিনি বলেন, ‘মানুষ যা, মানুষ আসলে তা না; মানুষ যা না, মানুষ আসলে ঠিক তাই’।
মানুষ কখনো কখনো ভবিষ্যতের ভাবনাচিন্তা করতে গিয়ে বর্তমানকে উপেক্ষা করে বসে। যা সার্ত্রের কাম্য নয়। ব্রেথলেস-এ মিশেলের মাধ্যমে গদার যেনো সেটাই বলতে চান। বর্তমানকেই যেনো ধরতে চান তিনি। সার্ত্রের তোলা প্রশ্নের জবাবটাও যেনো দিয়ে দেন গদার! ভবিষ্যতের ভাবনা মিশেলের মনে আসে না এমন নয়, তবে গদার সেটাকে ভিন্নভাবে অর্থায়ন করেন! চলচ্চিত্রের ১১ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডের দৃশ্যে প্যাট্রিসিয়ার কাছ থেকে মিশেল সংবাদপত্র কেনেন। এ সময় তাদের কথোপকথন ছিলো এমন–
মিশেল : এটা (সংবাদপত্র) ফেরত নাও। এখানে কোনো রাশিফল (Horoscope) নেই!
প্যাট্রিসিয়া : ‘রাশিফল’ কী?
মিশেল : ভবিষ্যৎ। আমি ভবিষ্যৎ জানতে চাই, তুমি চাও না?
প্যাট্রিসিয়া : অবশ্যই।
মিশেলের এই বক্তব্যে মনে হতে পারে, তিনি কেবলই ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হয়ে বর্তমানকে উপেক্ষা করছেন! কিন্তু এখানেই রয়েছে গদারের বর্তমান আর ভবিষ্যতের প্যারাডক্স! সংবাদপত্রকে বর্তমানতার সিম্বলিক অর্ডার মনে হলেও (যেহেতু সংবাদপত্র প্রাত্যহিকতাকে ধারণ করে) যখন তার কেবল নির্দিষ্ট একটা আধেয় ‘রাশিফল’ তথা ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা হয়, তখন ওই সময়ের জন্য যেনো তা ভবিষ্যতের সিম্বলিক অর্ডার হয়ে ওঠে। কিন্তু গদার যখন সেই ‘রাশিফল’টাই রাখেন না, অথচ মিশেলকে সেই ‘রাশিফলে’র দিকেই আগ্রহী করে তোলেন, তখন এই ভাবনা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তখন বিষয়টিকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রয়াসও পাওয়া যেতে পারে। সংবাদপত্রের রাশিফল মূলত রাশি অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির সেই দিনটা কীভাবে যাবে তার একটা ব্যাখ্যা হাজির করে। তার মানে এখানে ‘রাশিফলে’র অর্থ দাঁড়ায় প্রাত্যহিকতা (Everydayness) তথা বর্তমানতা (Presentness)! আর মিশেলের ‘রাশিফল’জানার আগ্রহ তাকে বর্তমানতার দিকেই ধাবিত করে! কাজেই মিশেলকে বরং বর্তমানের ভাবনাই ভাবতে দেখা যায়, কিন্তু তা ভবিষ্যতকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে নয়। কারণ এখনই যেটা বর্তমান মুহূর্তেই সেটা অতীতে রূপ নেয়। কাজেই বর্তমানকেও যথাযথভাবে চিহ্নিত করা মুশকিল হয়ে ওঠে। তবে প্রাত্যহিতকার মধ্যে যে বর্তমান রয়েছে সেইটার উপলব্ধি ও সেই সময়টাতে টিকে থাকাই মিশেলের কাছে সবচেয়ে গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। ব্রেথলেস-এর প্রথম দৃশ্যেও সেটা দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে মিশেলকে একটা গাড়ি চুরি করে পালাতে দেখা যায়। অথচ গাড়িটা দিয়ে তিনি কী করবেন সেটাই জানেন না! জানতেও চান না! মাঝপথে পুলিশ তাড়া করলে সবকিছুর মূলে যে চুরি করা গাড়ি সেটাকেই ফেলে রেখে চলে যান তিনি! আর এখানেই অপ্রধান হয়ে ওঠে ভবিষ্যতের ‘The Transcendence of the Ego', আর প্রাধান্য পায় মিশেলের বর্তমানতার ভাবনা। আবার প্যাট্রিসিয়া দোকান থেকে খাবার আনতে গিয়ে ফোন করে মিশেলের ঠিকানা বলে দেন পুলিশকে। ফিরে এসে মিশেলকে পালিয়েও যেতে বলেন। কিন্তু মিশেল পালান না। পালাতে পালাতে তিনি ক্লান্ত! তাই তো বন্ধুর কাছ থেকে টাকা আনতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘I’m fed up. I’m tired. I want to sleep.'! এ যেনো অনন্ত সেই বাসনারই মহাচ্ছেদ! যে বাসনা মানুষকে অহর্নিশ ঘূর্ণিপাকের মধ্যে তাড়া করে বেড়ায়! মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে হলেও সেই বাসনায় যেনো ছেদ ঘটাতে উন্মুখ মিশেল-রূপী গদার!
আলফাভিল তো পুরোটাই মানব সভ্যতার বীভৎস, যান্ত্রিক এক বাসনারই প্রতিধ্বনি। যান্ত্রিক শহরের এক যান্ত্রিক উপস্থাপন। তবে সেখানেও প্রাণের ছোঁয়া পাওয়া যায়। শেষ দৃশ্যে নাতাশা আর কশানকে গাড়িতে চড়ে অজানা উদ্দেশে পাড়ি জমাতে দেখা যায়। তারা কোথায় যাবে, জানে না। উদ্দেশ্য যেহেতু অজানা তাই সেখানে ভবিষ্যতের ‘The Transcendence of the Ego ' যেনো কোনো গুরুত্বই পায় না। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তাদের বর্তমানের বাসনা। তার প্রমাণ পাওয়া যায় নাতাশার কথায়। গাড়িতে যেতে যেতে তিনি কশানকে বলতে থাকেন,
The present is terrifying because it is irreversible and because it is cast in iron. Time is the substance of which I am made. Time is a river that carries me along. But I am time. It is a trigger tearing me apart. But I am the trigger. … We are the happiness and that is where we are heading.
বর্তমান নির্মমতায় ভরা! সে চলে গেলে আর তাকে ফিরিয়ে আনা যায় না। কিন্তু তাই বলে নাতাশা কিংবা কশান কেউই এই ভাবনাতেই পড়ে থাকে না। আরো দুইপা সামনে এগিয়ে সেই নির্মম বর্তমানের বাস্তবতার সম্মুখীন হতে দেখা যায় তাদেরকে। মানুষ নাকি সময়ের হাতে পরিচালন হয়, কিন্তু মানুষ নিজেই যদি সময়ের তৈরি ও তার সহযাত্রী হয়, তখন আর ভবিষ্যৎ বলে যেনো কিছু থাকে না। থাকে কেবল অনন্ত বর্তমান। আর পাঠক কিংবা দর্শককে এই অনন্ত বর্তমানের অনন্ত আকাঙ্ক্ষীই করে তোলেন গদার!
‘গদার অন গদার’
মানুষ সবসময় এক ধরনের দ্বান্দ্বিকতার মধ্য দিয়ে যায়। শিল্পীরা হয়তো আরো বেশি! সেটা কখনো কখনো ভয়াবহও হয়ে থাকে! গদারও এর বাইরের কেউ নন। গদার নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছেন। গদারের সমালোচক সত্তা তার শিল্পী সত্তাকে প্রশ্ন করছেন, শিল্প কী? কিংবা সিনেমাইবা কী? এই প্রশ্নের উত্তরে তার শিল্পী সত্তার জবাব শুনবার মতো!
Art attracts us only by what it reveals of our most secret self. This is the sort of depth I mean. Obviously it assumes an idea of man which is hardly revolutionary, and which the great film-makers from Griffith to Renoir were too conservative to dare to deny. So, to the question `What is Cinema?’, I would first reply: the expression of lofty sentiments.৪
গদারের কাছে ‘মহৎ আবেগ, অনুভূতিগুলো’ই ‘সিনেমা’ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও চলচ্চিত্র কোনো না কোনোভাবে আসলে নির্মাতার অনুভূতিগুলোরই বহিঃপ্রকাশ। তবে গদারের বেলাতে সেটাকে একটু ভিন্নভাবে বিবেচনা করা যেতেই পারে। তিনি আবেগ, অনুভূতিগুলোর ওপর আরো জোরারোপ করেই বলছেন, ‘মহৎ আবেগ, অনুভূতিগুলোই সিনেমা’!
গদারের প্রথম দিকের চলচ্চিত্রগুলো মূলত রাজনৈতিক (যদিও অরাজনৈতিক বলে কিছু নাই); বিশেষ করে ৬০-৭০’র দশকের চলচ্চিত্রগুলো। তৎকালীন সমাজ-বাস্তবতাই ছিলো তার চলচ্চিত্রের প্রধান উপকরণ। ৮০-এর দশকে এসে গদার প্যাশন (১৯৮২)-এর মতো মিউজিকাল ফিল্ম নির্মাণ করছেন। যদিও তার চলচ্চিত্রে মোৎজার্ট, বেটোফোন সব সময়ই হাজির থেকেছে। তবে আলাদা করে প্যাশনকে মিউজিকাল হিসেবে গণ্য করবার কারণ হিসেবে ফরাসি দার্শনিক আলাঁ বাদিউ তার ‘Cinema’ গ্রন্থে বলছেন,
This film, Passion, expresses or attempts to express, through music, an intermediate world, an in-between world. What’s more, in-between situations recur repeatedly as one of the film’s leitmotifs. How can an intermediate world be expressed through music? And first of all, what does “through music” mean? “Through music” implies the mystery of the work’s construction, because Passion is clearly a film based entirely on themes and variations. It is not based on the typical order of a story but neither is it based on an instantly intelligible symbolic order. It is really based on themes and variations, as well as on expositions, developments, and conclusions, which are also borrowed from music. If you pay close attention, you can see discern these three movements, the three classical movements of a concerto, in almost every scene.৫
বাদিউ প্যাশনকে পুরোটাই মিউজিকাল বলতে চান। কারণ চলচ্চিত্রটিতে মিউজিকই আসলে সবটা। যার মধ্য দিয়ে শিল্পীর অন্তঃপুরের উন্মেষ ঘটে, যেটা গদারের ‘secret self’-এর উন্মোচনের সঙ্গে মিলে যায়। তার কাছে সিনেমা মানেই অন্তঃপুরের উন্মেষ। যাইহোক বলতে গেলে প্যাশন-এ গল্প নাই বললেই চলে কিংবা থাকলেও ধরাবাঁধা গল্পের ন্যারেটিভে আবদ্ধ থাকেননি গদার। যদিও সেটা তিনি কখনোই থাকেননি। কিন্তু এই চলচ্চিত্রে ন্যূনতম গল্পেরও ধার ধারেননি তিনি। প্রথম দেখায় দর্শক বিমোহিত হবে হয়তো, কিন্তু বোধগম্য হবে না। সেইসঙ্গে গদারের ‘জাম্প কাট’তো রয়েছেই। এছাড়া চলচ্চিত্রটিতে সমসাময়িক তিনটি শিল্প আন্দোলনের প্রভাব লক্ষ করা যায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘Tableau Vivant’৬ বা ‘জীবন্ত ছবি’। চলচ্চিত্রের প্রোটাগনিস্ট জার্জি চলচ্চিত্রনির্মাতা। যিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সুইজারল্যান্ডে এসেছেন। তার নির্মাণে এই শিল্পান্দোলনগুলোর প্রভাব পুরোটাই উঠে আসে। চলচ্চিত্র নির্মাণে দেখা যায় জার্জি বেশ খুঁতখুঁতে। ফলে নির্ধারিত সময় অতিক্রম হওয়ার পরও তিনি কাজ শেষ করতে পারেন না। যে কারণে প্রযোজক লাজলো’র রোষানলে পড়তে হয় তাকে। শেষমেষ সবকিছু ছেড়ে তিনি পোল্যান্ডে পালিয়ে যান। যদিও এর আগেই তিনি স্থানীয় দুই নারী ইসাবেলা ও হান্না’র প্রেমে পড়েন। একপর্যায়ে এই দুজনই জার্জির খোঁজে পোল্যান্ডের উদ্দেশে যাত্রা করে। বলতে গেলে এই হচ্ছে প্যাশন-এর গল্প। অথচ এর মধ্য দিয়েই গদার তুলে আনেন সমসাময়িক শিল্পের হালচাল।
৯০-এর দশকে এসে নুভেল ভাগ (১৯৯০)-এর মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন গদার। যেখানে ৬০-এর দশকে ঘটে যাওয়া ফরাসি চলচ্চিত্র আন্দোলন নুভেল ভাগের ‘Aura’ বা ‘মহিমা’কেই নতুন এক কর্তাসত্তার মোড়কে মূল্যায়ন করতে চান গদার। প্রশ্ন জাগে, গদার কি তবে রোমান্টিসিজমে ভুগছিলেন! হয়তো হ্যাঁ, কিংবা না! ওই সময়ে দাঁড়িয়ে গদারের মধ্যে হয়তো এই ধরনের বোঝাপড়া তৈরি হতে পারে, যেকোনো যুগেই কোনো একটি চলচ্চিত্র হয়ে উঠতে পারে সেই সময়ের নতুন সিনেমাদর্শনের হাতিয়ার! নুভেল ভাগ-এর গল্পটা অনেকটা সেরকমই। এলিনা টার্লেটো-ফেভরিনি নামে এক শিল্পপতির নিয়মিত সম্পর্ক রয়েছে এক পুরুষ যৌনকর্মীর (জিগোলো) সঙ্গে। চলচ্চিত্রের শুরুতে এলিনাকে একা লঙ ড্রাইভে যেতে দেখা যায়। রাস্তায় তার পরিচয় হয় রজার লেনক্স নামে এক পুরুষের সঙ্গে। রজার হাত বাড়িয়ে দেন এলিনার দিকে। সেই হাত ধরতে ধরতে এলিনাকে বলতে শোনা যায়, ‘How wonderful ... to be able to give what you don’t have.’। এলিনার এই কথা শুনে মনে পড়ে যায় জাক লাকাঁর সেই জুইসাঁস বা পরমানন্দ (Jouissance) ক্ষরণ করবার মতো লাইন, ‘আপনার অ-ভাবকে অপরের অ-ভাব দিয়ে পূর্ণ করবার নামই হইলো ভালোবাসা’, কিংবা ‘যাহা নাই তাহা দেওয়ার নামই ভালোবাসা’। যাইহোক এলিনা প্রেমে পড়েন অপরিচিত রজারের। এখন কথা হচ্ছে, একজন যৌনকর্মীর সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যেও কি কোনো ‘প্রেমে’র টান থাকে না! না থাকলে কীসের তাড়না তাদের একত্র করে! কেবলই কি অর্থ, যৌনতা নাকি এর থেকেও বেশি কিছু! রাস্তায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া কুকুরটার সঙ্গেও (কোনো স্বার্থ নেই তবুও) তো পথচারীর যে সম্পর্ক তৈরি হয় সেটাকে ভালোবাসা না বলে আর কী বলা যায়! আর এখানে তো অনেকদিন ধরে একসঙ্গে থাকা জলজ্যান্ত মানুষ! কাজেই কিছু একটা থাকে বলেই হয়তো লাকাঁ পারস্পরিক ‘অ-ভাব’ পূরণের মাত্রাগত দিকটাকেই ‘প্রেম’ বা ‘ভালোবাসা’ বলেন! এই তাড়নাই আসলে এখানে বড়ো কথা! ফলে এলিনার জিগোলোর সঙ্গে প্রথাগত সম্পর্ক ছেড়ে রজারের সঙ্গে প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, এবং কর্পোরেটীয় জীবন ত্যাগ করে চলে আসার ওপর ভর করেই হয়তো চলচ্চিত্রটির নামকরণ করা! এর সঙ্গে গদার টেনে আনেন নুভেল ভাগকেও। নুভেল ভাগকে গদার কেবল একটা সময়ের মধ্যে আবদ্ধ করতে অনাগ্রহী। প্রথাগত ন্যারেটিভ থেকে বেরিয়ে নতুন করে চলচ্চিত্রকে ভাববার যে অবকাশ সেটাকে গদার হয়তো এলিনার সম্পর্কের ডাইমেনশনের মধ্য দিয়ে তুলে ধরতে চান।
যেকোনো সময়ের যেকোনো নতুন ভাবনাই নুভেল ভাগের অংশ; যেমনটা এলিনার তৈরি হওয়া নতুন সম্পর্কের নতুন ডাইমেনশন! ‘Everything Is Cinema: The Working Life of Jean-Luc Godard’ গ্রন্থে মার্কিন চলচ্চিত্র সমালোচক রিচার্ড ব্রডি চলচ্চিত্রের প্রথম পুরুষটিকে The Old Wave, নারীটিকে The Producer, The Industry ও দ্বিতীয় পুরুষটিকে The New Wave -এর সিম্বলিক অর্ডার হিসেবে ভেবেছেন।৭ যদিও গদার এটাকে বাইবেলীয় ধারায় ব্যাখ্যা করেন। গদার The Old Testament -কে ভেবেছেন The Old Wave এবং The New Testament-কে ভেবেছেন The New Wave-এর মেটাফর হিসেবে। তার মতে, The Old Testament -এর অংশ হয়ে ওঠে গ্রিফিথ, স্ট্রহেইম, অরসন ওয়েলস কিংবা এ ধরনের নির্মাতাদের ক্লাসিকাল যুগের নির্মাণ ও প্রথা অনুগামী অবস্থান। অন্যদিকে এবং The New Testament ধারণ করে The New Wave -এর গল্প! গদারের নিজস্ব গল্প!৮ এটাকে কেবল গদারের নিজস্ব গল্প বললে হয়তো ভুল বলা হবে। বরং হয়ে ওঠে গদারকে ধরে সমস্ত নির্মাতারই প্রথাবিরোধী, নিজস্ব ও নতুন গল্প বলবার ঢঙ! যেটাকে গদার ৯০-এর দশকে এসে নতুন কর্তাসত্তার আবির্ভাব হিসেবে স্বীকৃতি জানিয়ে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ‘নুভেল ভাগ’হিসেবে!
‘গদার আনডার গদার’
একুশ শতকে এসে গদারকে আরো বেশি ‘দুর্বোধ্য’মনে হয়। একুশ শতকের গদার কেনো জানি প্রকৃতির নেশায় মত্ত! সবুজ পাহাড়, সুনীল সমুদ্রের হাতছানিতে সাড়া দিতে ব্যস্ত! এটা কি তবে তার দর্শক বিচ্ছিন্নতারই চরম নমুনা! যেটা তার প্রথম দিকের বক্তব্য—I don’t make film for the masses but through the masses—এর মধ্যে অনেক আগেই খেয়াল করা গিয়েছিলো! এই সময়ে দাঁড়িয়ে এটাকে কেবল দর্শক বিচ্ছিন্নতা হিসেবে ভাবা যায় না, বরং তা হয়ে ওঠে পুরো পৃথিবী থেকেই বিচ্ছিন্নতার অ্যালিগরি! একাধারে তার শেষ দুইটি চলচ্চিত্র গুড বাই টু ল্যাঙ্গুয়েজ (২০১৪) এবং দ্য ইমেজ বুক (২০১৮)-এ এই প্রভাব বেশ ভালোভাবেই ধরতে পারা যায়। ২০১০-এ নির্মাণ করা সোশালিজমকে একটু ব্যতিক্রম মনে হলেও বাকি দুটি চলচ্চিত্র গুড বাই টু ল্যাঙ্গুয়েজ ও দ্য ইমেজ বুক গদারকে যেনো আরো বেশি নিভৃতচারী করে তোলে। তার চলচ্চিত্রকে বিদায় জানানোই যেনো স্পষ্ট হয়ে ওঠে এখানে! তবুও সোশালিজম-এ গদারকে বেশ রাজনৈতিক সচেতন বলেই মনে হয়। এখানে গদার সমাজতন্ত্রের উত্তরাধুনিক পাঠ তুলে ধরেন। যে কারণে সোশালিজমকে পোস্টমডার্ন সিনেমাতেও স্থাপন করা হয়। একইসঙ্গে সমসাময়িক বৈশ্বিক রাজনীতির বিষয়গুলোও বেশ ভালোভাবেই উঠে আসে গদারের এই নির্মাণে।
গুড বাই টু ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে গদারের নিজের লেখা নোট পাঠকের সামনে তুলে ধরা যেতে পারে, তাতে হয়তো আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে চলচ্চিত্রটির সারবস্তু। চলচ্চিত্রটি মূলত দুটো ভাগে বিভক্ত—প্রথম অংশ ‘1 Nature’-এ একটা প্রেমের কাহিনি দেখা যায় এবং দ্বিতীয় অংশ ‘2 Metaphor’-এও আরেকটি প্রেমের কাহিনিকেই তুলে ধরেন গদার। গুড বাই টু ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে গদার তার নোটবুকে কবিতার মতো করে লেখেন,
The idea is simple:
A married woman and a single man meet.
They love, they argue, fists fly.
A dog strays between town and country.
… … …
A second film begins:
the same as the first,
and yet not.
From the human race we pass to metaphor.
… … …
people talking of the demise of the dollar,
of truth in mathematics
and of the death of a robin.৯
‘একজন রবিন’ কিংবা ওই ‘কুকুর’টা যেনো গদার বাদে আর কেউ নন! কুকুরটা দুটো সম্পর্কের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটা অবলোকন করেও একটা ‘ঘেউ’ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারে না! কিংবা তার অব্যক্তকে ব্যক্ত করতে পারলেও তা বোঝে ক’জন! লাকাঁ’ও তার শেষ দিকে এসে এই ভাষার বাহির পথেরই সন্ধান করেছেন! গদারও হয়তো সেই পথই ধরলেন। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, শেষ বয়সে এসে সবাই কেনো ‘বাহির পথ’ খোঁজে! সেই সময়টাতে ‘বাহির’ কেনো এতো টানে!
দ্য ইমেজ বুক (২০১৮)-কে অনেকটা সেই ‘বাহিরের টানের’ই অংশ বলে মনে হয়! কারণ এই চলচ্চিত্রটিতে গদার কোলাজ, বিভিন্ন চলচ্চিত্রের ক্লিপ (বিশেষ করে নিজের চলচ্চিত্রেরই ক্লিপ), পেইন্টিং, স্টিল ফটোগ্রাফ, গ্রাফিক্স ও কিছু ডকুমেন্টারি ফুটেজ ব্যবহারের পাশাপাশি ভয়েস-ওভারও (Copious Voice-Overs) দিয়েছেন। এখানে যেনো গদার আরো বেশি স্মৃতিকাতর! কিন্তু এর মধ্য দিয়েই গদার তুলে আনেন চলচ্চিত্রের ইতিহাসকে। যা তার হিস্টরিজ দ্যু সিনেমা (১৯৮৮-১৯৯০) এর সিক্যুয়াল বা এপিলগ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
‘স্বেচ্ছামৃত্যু’ : মৃত্যু মানে দারুণ করে জীবিত হওয়াও বটে!
মানুষ কি কেবল বাঁচতে চায়? নাকি মরবার বাসনাও তার থাকে বা তৈরি হয়? কিংবা জীবন মৃত্যুইবা কী, কী এর সংজ্ঞায়ন? এইসব প্রশ্নের উত্তর কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে করা মুশকিল! জিজ্ঞাসাগুলোর হয়তো কিছুটা ফয়সালা পাওয়া যায় জার্মান দার্শনিক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের দার্শনিক ভাবনায়। তার পরও তিনি কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে এর ফয়সালা টানতে চাননি। দাঁড়ানো কিংবা ফয়সালাটাও জরুরি নয়। ফ্রয়েডের প্রথম দিকের কাজ মূলত ‘Pleasure Principle’-এর ওপর ভর করেই সামনে এগোয়। তিনি বলেন, মানুষ আসলে বাঁচতে গিয়ে সবসময় সুখ খোঁজে। মানুষের এই বেঁচে থাকবার জন্যে সুখের আকাঙ্ক্ষার নামই ‘Eros' বা ‘জীবনবাসনা’। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরই ফ্রয়েড তার মত পাল্টান। মত পাল্টান এ কারণেই যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মানুষকে সুখ সন্ধানী প্রাণীর বিপরীতে রীতিমতো সহিংস প্রাণী (Violent Animal) হিসেবেই প্রতিপন্ন করে। ‘সভ্য’ সমাজের সৃষ্ট প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চার কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিলো! আর এই পাটাতনে দাঁড়িয়েই ফ্রয়েড জানালেন, মানুষ কেবল জীবন/সুখই খোঁজে না, সমান্তরালে মৃত্যু/দুঃখেরও অনুসন্ধিৎসু। মানুষের বাসনা কেবল সুখ নয়, এর থেকেও বেশি কিছু! অর্থাৎ মানুষ কেবল ‘Pleasure Principle’ই নয় সমান্তরালে ‘Beyond Pleasure Principle’ দিয়েও পরিচালিত। আর এখানেই ফ্রয়েডের ‘Thanatos’ বা ‘মরণবাসনা’ ধারণার উৎপত্তি। অর্থাৎ মানুষ জীবন-মরণ বাসনার সমন্বয়! ধরায় জীবন যতোটা গুরুত্বপূর্ণ মরণও ঠিক ততোটাই গুরুত্বের দাবিদার, যেনো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ! ভবমাঝার যেনো জীবনমৃত্যুর লীলায় পরিপূর্ণ! এই লীলার কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘রুদ্ধ গৃহ’ প্রবন্ধের কয়েকটা লাইন মনে পড়ে যায়—
পৃথিবী মৃত্যুকেও কোলে করিয়া লয়, জীবনকেও কোলে করিয়া রাখে; পৃথিবীর কোলে উভয়েই ভাই-বোনের মতো খেলা করে। এই জীবনমৃত্যুর প্রবাহ দেখিলে, তরঙ্গরঙ্গের উপর ছায়া-আলোর খেলা দেখিলে, আমাদের কোনো ভয় থাকে না; কিন্তু বদ্ধ মৃত্যু, রুদ্ধ ছায়া দেখিলেই আমাদের ভয় হয়। মৃত্যুর গতি যেখানে আছে, জীবনের হাত ধরিয়া মৃত্যু যেখানে একতালে নৃত্য করে, সেখানে মৃত্যুরও জীবন আছে; সেখানে মৃত্যু ভয়ানক নহে।১০
ফরাসি দার্শনিক জাক লাকাঁও মৃত্যুকে মেনে নিয়েই সামনে এগোতে বলেন। কারণ জীবনে আর কোনো কিছু নির্ধারিত থাকুক আর না থাকুক মৃত্যু নির্ধারিত, অবধারিত। তাই তাকে এড়িয়ে যাওয়াটা কখনোই সম্ভবপর হয়ে ওঠে না মানুষের পক্ষে। বরং মৃত্যুকে মেনে নিতে পারার মধ্যেই রয়েছে জীবনের স্বার্থকতা; জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলবার সক্ষমতা। লাকাঁর বক্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য—
Death belongs to the realm of faith. You’re right to believe that you’re going to die, of course. It keeps you going. If you didn’t believe in it, could you bear the life you have? If you didn’t hold firmly to this certainty that it will come to an end, could you bear to go on with all this? Nevertheless, it is but a leap of faith. And, to top it all, you’re not sure of it.১১
এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে গদারের ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’কে কীভাবে, কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে? মনে পড়ে মার্কিন সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’কে—শর্টগান দিয়ে নিজেই নিজের মাথায় গুলি করে মৃত্যুবরণ করেন! কিংবা ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ—নিজের পেটে নিজেই গুলি করে মারা যান! কিন্তু গদারের ক্ষেত্রে ঘটনাটা একটু ভিন্ন। বলা হয়েছে, ৯১ বছর বয়সে মারা যাওয়া গদার নাকি মৃত্যুর আগে ‘জীবনের পড়ন্ত বেলায় ছিলেন ক্লান্ত’১২। তাহলে এই ‘ক্লান্তি’রই কি অবসান চেয়েছিলেন গদার! এজন্যই কি তিনি বেছে নিলেন ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’! অবশ্য আগেই বিদায় জানিয়েছিলেন চলচ্চিত্রকে। যার জীবনটাই ছিলো একটা চলচ্চিত্র, সেই তিনিই যদি চলচ্চিত্রকে বিদায় জানান, আর কীইবা বাকি থাকে তখন! বেছে নিলেন ‘অ্যাসিস্টেট সুইসাইড’১৩! ফ্রান্সে এর বৈধতা না থাকায় চলে এসেছিলেন তার জন্মভূমি সুইজারল্যান্ডে। নিরালায়, নিভৃতে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন আজীবন কথা বলে যাওয়া গদার! গুড বাই টু ল্যাঙ্গুয়েজ (২০১৪) দিয়ে কথাকেও জানিয়েছিলেন বিদায়! হেমিংওয়ে যেমন লেখক হওয়াটাকেই বেছে নিয়েছিলেন। অনবদ্য দক্ষতা প্রয়োগ করেছিলেন তার রচনারীতিতে; এক আবেগমথিত জীবন যাপন করেছিলেন। যখন শরীর ও মন তার ডাকে সাড়া দিতে পারছিলো না, তখনই টেনে দিয়েছিলেন বন্দুকের ট্রিগার! গদারের বেলাতেও হয়তো তেমনটাই ঘটেছিলো! বৃদ্ধ বয়সের জরাগ্রস্থতার চেয়ে মৃত্যুকেই তার বেশি আপন মনে হয়েছিলো হয়তো! আজীবন তারুণ্যের প্রতিনিধিত্ব করা গদারের পক্ষে সেটা মেনে নেওয়াটা বড়ো কষ্টেরই বটে! তাইতো মানুষের মধ্যে চিরদিনের জন্য তরুণ হয়েই থেকে গেলেন! তখন কেবল জীবনানন্দের ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাখানির কথাই মনে পড়ে বার বার—
আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা,
সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মত এসে জাগে
ধূসর মৃত্যুর মুখ;–একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিল–সোনা ছিল যাহা
নিরুত্তর শান্তি পায়;–যেন কোন্ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।
কি বুঝিতে চাই আর? ... রৌদ্র নিভে গেলে পাখি-পাখালীর ডাক
শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক!
কিংবা ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার-এর ‘ভ্রমণ’১৪ কবিতার কয়েক পঙ্ক্তি বলে যেতে ইচ্ছে করে ভীষণ—
হে মৃত্যু, সময় হ’লো! এই দেশ নির্বেদে বিধুর।
এসো, বাঁধি কোমর, নোঙর তুলি, হে মৃত্যু প্রাচীন!
কাণ্ডারী, তুমি তো জানো, অন্ধকার অম্বর সিন্ধুর
অন্তরালে রৌদ্রময় আমাদের প্রাণের পুলিন।
ঢালো সে-গরল তুমি, যাতে আছে উজ্জীবনী বিভা!
জালো সে-অনল, যাতে অতলান্তে খুঁজি নিমজ্জন!
হোক স্বর্গ, অথবা নরক, তাতে এসে যায় কী-বা,
যতক্ষণ অজানার গর্ভে পাই নূতন—নূতন!
লেখক : মাহমুদুল হাসান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
hasanalmahmud60@gmail.com
https://www.facebook.com/mahmud.alhasan.14418
তথ্যসূত্র ও টীকা
১. Godard, Jean-Luc; (1986: 59); “`From Critic to Film-Maker’: Godard in Interview (extracts)”; Cahiers Du Cinema: 1960-1968: New Wave, New Cinema, Reevaluating Hollywood; Edited by Jim Hillier; Harvard University Press, Cambridge, Massachusetts, USA.
২. নীৎশে সমাজের ত্রাতা হিসেবে এমন এক অতিমানবসত্তাকে কল্পনা করেছেন, যিনি সমাজের সব ধরনের অসঙ্গতি দূর করবেন। যার নাম তিনি দিয়েছেন ‘Overman'। নীৎশে তার ‘Thus Spoke Zarathustra' বইয়ের ‘Zarathustra’s Prologue' অধ্যায়ে ‘Overman '-এর সংজ্ঞায়ন করেছেন এভাবে, ‘Behold, I am a herald of the lightning and a heavy drop from the cloud: but this lightning called overman.'| `Zarathustra’৩০ বছর বয়সে পর্বতে গিয়ে থাকবার সিদ্ধান্ত নেন। ১০ বছর পর পর্বত থেকে ফিরে ঘোষণা করেন, ‘God is dead’। নীৎশের কাছে ‘Zarathustra’ই হলো প্রকৃত ‘Overman' বা তার প্রতিনিধি/দূত। কিংবা ‘Overman 'কে তিনি ‘Sea' ও ‘Madness'-এর সঙ্গেও তুলনা করেছেন। তার মানে নীৎশের ‘Overman ' সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা কোনো ধরনের নৈতিকতাকেই প্রশ্রয় দেন না। তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ব্রেথলেস-এ মিশেলকেও একইভাবে ভাববার অবকাশ থাকে। মিশেলও সমাজ-রাষ্ট্রের তোয়াক্কা না করে চুরি, ছিনতাই, যৌনতা ইত্যাদি করে বেড়ান। তার নিজের ওপর যেমন নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তেমনই তিনি অন্যের ওপরেও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চান। তিনি হতে চান রূপালি পর্দার গ্যাঙস্টার (হামফ্রে বোগার্ট)! অমরত্বের পিয়াসী! সমাজের নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মিশেল প্রতিনিয়ত লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে চান। কোনো ধরনের আপত্তি ছাড়াই প্রতিকূলতাকে যেনো বুক পেতে কাছে টেনে নেন বন্ধু ভেবে! আর এখানেই নীৎশের ‘Overman '-এর সঙ্গে মিলে যায় গদারের মিশেল।
৩. Sartre, Jean-Paul; (2011: xlv) `The Pursuit of Being’; Being and Nothingness: An Essay on Phenomenological Ontology; Translated by Hazel E. Barners, University of Colorado, USA.
৪. Godard, Jean-Luc; (1986: 31); Godard on Godard; Translated and Edited by Tom Milne and Jean Narboni; Plenum Publishing Corporation, New York, USA.
৫. Badiou, Alain; (2013: 166); `Passion, Jean-Luc Godard’; Cinema; Translated by Susan Spitzer; Polity Press, Cambridge, UK.
৬. ‘Tableau Vivant’ বা ‘জীবন্ত ছবি’ হলো জীবন্ত অভিনয়শিল্পী বা মডেলের সমন্বিত স্থিরচিত্র। সেখানে অভিনয়শিল্পীরা কস্টিউম, মেকআপ, প্রপস পরিধান করে নাটকীয়তার সঙ্গে সাধারণত চুপচাপ ও স্থিরভাবে নিজেদেরকে মঞ্চে উপস্থাপন করে। মনে হবে কোনো পেইন্টিং, আসলে সেগুলো জীবন্ত মানুষ কোনো পেইন্টিং নয়!
৭. Brody, Richard (2009: 600-601); Everything Is Cinema: The Working Life of Jean-Luc Godard; Henry Holt and Company, LLC; New York, USA.
৮. প্রাগুক্ত; Brody (2009: 600-601).
৯. `ADIEU AU LANGAGE (GOODBYE TO LANGUAGE)’; দেখুন : https://tinyurl.com/yfh4v54t; retrieved on : 11.05.2023
১০. ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ (১৯৫৭ : ৩৫-৩৬); ‘রুদ্ধ গৃহ’; বিচিত্র প্রবন্ধ; বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, কলিকাতা।
১১. Lacan, Jacques; The Louvain Lecture, 1972; Lacanian Soundbites: “Death is But a Leap of Faith”; Catholic University of Louvain, Belgium; দেখুন : https://rb.gy/1ri3h; retrieved on : 11.05.2023
১২. “‘জ্যঁ-লুক গদারের ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’”; দেখুন : https://rb.gy/mfy0r; retrieved on: 12.05.2023
১৩. অ্যাসিস্টেট সুইসাইড হলো কোনো দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বৈধতা প্রদান করা মৃত্যুবিষয়ক আইনী প্রক্রিয়া। যে আইনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন নাগরিক চিকিৎসকের সহায়তায় স্ব-ইচ্ছায় মৃত্যুবরণ করতে পারে।
১৪. বোদলেয়ার, শার্ল (১৩৬৭ : ১৬৪); শার্ল বোদলেয়ার : তাঁর কবিতা; অনুবাদ, ভূমিকা, টীকা, কালপঞ্জী ও জীবনী : বুদ্ধদেব বসু; দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন