Magic Lanthon

               

কামার আহমাদ সাইমন

প্রকাশিত ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

“সামষ্টিক অবস্থান বা অস্তিত্বের মধ্যে ‘ব্যক্তি’ হিসেবে আমি এক অতি ক্ষুদ্র কণা”

কামার আহমাদ সাইমন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একাডেমিক ভবনের ১৫০ নম্বর কক্ষে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ গত ১৪ অক্টোবর ২০২৩-এ ‘নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন-এর সঙ্গে একবেলা’ শিরোনামে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেই অনুষ্ঠানে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, ‘ম্যাজিক লণ্ঠন আড্ডা’, ‘ম্যাজিক লণ্ঠন বাতচিত’ (দর্শকের মুখোমুখি নির্মাতা) এর আয়োজন করা হয়। শুনতে কি পাওনীল মুকুট চলচ্চিত্র দুইটি প্রদর্শনের পর ‘ম্যাজিক লণ্ঠন বাতচিত’ মানে দর্শকের মুখোমুখি হন নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন। বাতচিতের প্রথম পর্ব অনুলিখন করে জুলাই ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়েছিলো। এবার শেষ পর্ব ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর পাঠকের জন্য হাজির করা হলো। — সম্পাদক

দ্বিতীয় পর্ব

সৈয়দ ইকরামুল হাসান : হ্যালো, আমি সৈয়দ ইকরামুল হাসান। পড়াশোনা করছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। আমার প্রশ্নটা হচ্ছে, আমি যখন প্রথম শুনতে কি পাও দেখি এর মধ্য দিয়ে আমি আপনার চলচ্চিত্র ভাবনা বা চর্চার যে জায়গাটিকে এক্সপ্লোর করতে পেরেছি, সেটা হলো আপনার চলচ্চিত্রভাষা। এই ভাষার মাধ্যমে স্বাধীনধারার চলচ্চিত্রে আপনি কীভাবে আপনার মধ্যে সেই সাহসটা বা অনুপ্রেরণাটা আনতে পারলেন? আমরা যদি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের দিকে তাকাই দেখবো, মেইনস্ট্রিম চলচ্চিত্রের পাশাপাশি স্বাধীনধারার চলচ্চিত্রের বিকাশ এখানে হয়েছে। সেই চলচ্চিত্রের ন্যারেটিভ থেকে আপনার ন্যারেটিভ অনেকটাই আলাদা বলা চলে। যেখানে একাধিক ক্যারেক্টার বা কোনো একটা পার্টিকুলার ক্যারেক্টারকে ফোকাস করে সেখান থেকে পুরো গল্পটাকে ডেভেলপ করা হয়। তবে আপনার চলচ্চিত্রের যে নির্মাণ পদ্ধতি, সেখানে কোনো পার্টিকুলার ক্যারেক্টারের ডেভেলপমেন্ট আমরা দেখতে পাই না। কোনো একটা ক্যারেক্টার সেই ইমোশনকে কানেক্ট করার পরিবর্তে প্রত্যেকটা মানুষ—যারা যুক্ত আছে—তাদের সবার সঙ্গে কানেক্ট করতে পেরেছি। আমার প্রশ্নটা যদি আমি আরেকটু কনসাইজ করি, আপনার এ রকম ন্যারেটিভে গল্প বলার যে ইচ্ছা, সেই ইচ্ছার অনুপ্রেরণাটা ঠিক কোথায় পেলেন বা কীভাবে পেলেন? পরবর্তী সময়ে যারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করবে, তাদের প্রতি আপনার কী এক্সপেক্টেশন কিংবা সেই ন্যারেটিভ নিয়ে তারা কীভাবে ভাববে? ধন্যবাদ।

কামার : শেষের অংশটা দিয়েই শুরু করি। শেষটা আসলে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি আমার জায়গা থেকে রেসপন্স করার চেষ্টা করছি। সমসাময়িক আমার খুব প্রিয় একজন লেখক মোহাম্মদ আজম; বক্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক। ওর একটা অসাধারণ কথা আমার খুব ভালো লেগেছে। ও বলে ‘ব্যক্তি একটা বোগাস আইডিয়া’। এই টাইটেলে ইউটিউবে আপনি একটা বক্তৃতাও পাবেন। খুব যে পুরনো তাও নয়। ব্যক্তি যে বোগাস আইডিয়া এইটা আমাদের সবকিছু গুলিয়ে ফেলছে। আমাদেরকে রেনেসাঁস ও ইউরোপের ফিলোসফিকাল বিবর্তনটা বুঝতে হবে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের নামে, মানে ‘ইন্ডিভিজ্যুয়ালিজম/লিবার্টি’ নামে আমরা এমনভাবে ব্যক্তিকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, রুটলেস করে ফেলেছি; সেটা আমরা এখনো করছি কিনা জানি না, আমরা করার চেষ্টা করছি। এই জায়গাটা থেকে আজমের কথাটা আমি কোট করেই বলছি—‘ব্যক্তি একটা বোগাস আইডিয়া’¾এটা সত্যিই আমার কাছে খুবই বোগাস মনে হয়। আমি কি কোনোভাবেই আমার আশপাশের মানুষের বাইরে? আমার নিজের ভালো লাগা, খারাপ লাগা নিয়ে বা (শুনতে কি পাও ছবিতে) একটা ফ্যামিলির কথা বললাম—আমার একটা ফ্যামিলি আছে, স্ত্রী আছে, বাবা আছে—আমাদের তো তিন প্রজন্মের একটা স্ট্রাকচার তৈরি হয় বা ছিলো কয়েকদিন আগে। যদিও এখন ভেঙে গেছে। এই তিন প্রজন্মের স্ট্রাকচারের বাইরে আমি আসলে কতোটুকু?

আপনি এখানে গ্রাজুয়েশন করতে আসছেন; চার-পাঁচ বছর থাকবেন ম্যাক্সিমাম। আগামী ৩০ বছরে এখানকার তিন চারজনের সঙ্গে আর আপনার দেখা হবে কিনা সেটা জানেন না। কিন্তু আপনার চারপাশে যাদের সঙ্গে যোগাযোগ, সেটা কাজের সূত্রে, পারিবারিক সূত্রে, কিংবা সামাজিক বোঝাপড়ার সূত্রে হোক, ভালো লাগা এবং ভালোবাসা সূত্রে হোক—সেই ব্যক্তিরা মিলেই আপনি। চারপাশটাকে ভুলে আমাদের সবকিছুকেই সাংঘাতিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে ফেলছি আমরা। আমি যখন দেখি, সুলতানের ক্যানভাস থেকে শুরু করে ওই চায়ের দোকানের মানুষগুলোকে যখন ডিসকভার করি—আমার নিজের রিয়েলাইজেশন এটা—আমি এটা নিয়ে মোটেও কনসাস ছিলাম না। কয়েকদিন আগে আজম আমার একটা ছবির রিভিউতে এই কথাটা আলোচনা করেছিলো, ব্যক্তি থেকে সামষ্টিকে যাওয়ার ব্যাপারে আমার যে প্রবণতা এটা আমি খুব কনসাসলি করেছি বলে আমার মনে হয় না।

আবার একইসঙ্গে আমি যদি আমার ঋণ স্বীকার করি সাহিত্যের কাছে, সুলতানের কাছে, সুলতানের চিত্রকলার কাছে ও আমার সহজিয়া দর্শনের কাছে বা লালনের কাছে, তাহলেও আমি দেখি আসলে ‘ব্যক্তি’ বলে কোনো কিছু নাই। সামষ্টিক অবস্থান বা অস্তিত্বের মধ্যে ‘ব্যক্তি’ হিসেবে আমি এক অতি ক্ষুদ্র কণা। একটা বিষয় আপনারা জানেন কি না—ওই যে ছেলেটা সুইসাইড করলো—আপনারা কি জে এন ইউ’র সেই ছেলেটার (Ruhith Vemula) সুইসাইড নোটটা সম্পর্কে জানেন? ওই ছেলেটা মৃত্যুর আগে লিখেছিলো, ‘ফ্রম স্যাডোস টু দ্য স্টারস’। মানে আমরা সবাই কিন্তু একটা স্টারডাস্ট মাত্র। এই পুরো ইউনিভার্সের গল্প পড়েন। আমার পড়তে মজা লাগে। আমি কোনো আঁতলামি করছি না। আমি হাসছি অন্য একটা কথা চিন্তা করে। আমার কথাগুলো এই মুহূর্তে যারা শুনছেন তারা হয়তো ভাবছেন আমি আঁতলামি করছি। বাট আমি মোটেও আঁতলামি করছি না। আমার কাছে মনে হয়, উই আর নাথিং বাট স্টারডাস্ট। সূর্যের উৎপত্তি থেকে শুরু করে গোটা ইউনিভার্সের গল্প যদি দেখেন, তাহলে বুঝতে পারবেন।

এলিমেন্ট পিরিয়ডিক নিয়ে আমি একটু পড়ছিলাম। এলিমেন্ট মানে হচ্ছে মৌলিক পদার্থের যে পিরিয়ডিক টেবিল, যেটা পর্যায় সারণি। ওখানে দেখবেন একটা থেকে দুইটা, দুইটা থেকে তিনটা এমন রিপ্রোডিউজ করে করে আজকে ১১৪টা না কয়টা জানি হয়েছে। এই পুরো আইডিয়াটা আপনি সায়েন্স থেকে শুরু করে, ফিলোসফি, হিস্ট্রি—সব জায়গায় পড়ছেন যে, ইউ আর নাথিং বাট স্টারডাস্ট। কিন্তু আমাদের পুঁজিকেন্দ্রিক উন্নয়ন রেটোরিক, আমাদেরকে শেখাচ্ছে, আমিই সব, বাকি সব মিথ্যা। এটাকে একটা ফিলোসফিকাল বা পলিটিকাল পজিশন বলতে পারেন। আমার এটা কনসাস, আমার নিজের ইউনিক কোনো ডেফিনেশন অবশ্যই না। এটা আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিং। এইটা হয়তো পরে চেঞ্জ হবে। এটা কালেক্টিভের অংশ মাত্র।

আমাদের স্বাধীন চলচ্চিত্র ধারার যে উত্তরাধিকার সেটা ৬০-এর দশক থেকে শুরু হয়ে ৭০ দশকে এসে একটু চাপ খেয়েছিলো। তার পরও ৮০ দশকে বেশ বড়ো একটা রমরমা অবস্থা হয়েছিলো। এর পর ৯০ দশকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা পর্যায়ে আসলো। এই পুরো ধারাটা নিয়ে যদি আপনি একটু রিসার্চ করেন, দেখবেন এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কতোগুলো আন্দোলন এবং গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন মানুষ তাদের নিজেদের মতো করে কিছু বয়ান তৈরি করেছে। সেই বয়ানটায় খুব স্বাভাবিকভাবে, সাংঘাতিকভাবে আমরা হচ্ছি তার উত্তরাধিকার।

তাদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, আপনার প্রশ্নের জন্য আমি এই প্রথম কথাটা তুললাম যে, একটা জায়গায় আমি খুব সাংঘাতিকভাবে ডিফার করি এই আন্দোলনটার সঙ্গে। সেটা হচ্ছে, আপনি আমাকে বললেন আমার ছবিটা অন্যান্য ছবি থেকে আলাদা কেনো? সত্যি কেনো আলাদা তা আমি জানি না। এটা বলতে গিয়ে আমি এখন আপনার উত্তরটা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমি একটা উদাহরণ দিয়ে বলি, ২০০০-২০০২ সালের তিনটা ছবির নাম বলছি, তারেক মাসুদ-এর মাটির ময়না, তানভীর মোকাম্মেল-এর লালসালু ও মোরশেদুল ইসলাম-এর একটা ছবি রিলিজ হয়েছিলো তখন—যারা ওই সময়ের খবর রাখেন তারা হয়তো বলতে পারবেন—ইফ আই অ্যাম নট রং ছবিটার নাম বর্ষা বা বৃষ্টি। এ রকমই কিছু একটা। যেটা নিয়ে খুবই ডিবেট হয়েছিলো। আপনারা চেক করে দেখতে পারেন ২০০০, ২০০১ সালের দিকের ছবি। আপনারা ইন্টারনেটে পাবেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মানস চৌধুরীর লেখায় ‘তত্ত্বতালাশ’ নামের একটা জার্নালে ওই ছবিটার প্রসঙ্গ আসছে। ওটা নিয়ে খুব ডিবেট হয়েছিলো। ওই ছবিটার কপি কোথাও পাওয়া যায় না। এবং ওটা কোনো একটা ছোটোগল্পকে বেইজ করে।

যাইহোক, নামটা ভুল হতে পারে, আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু এই ২০০০-২০০২ সালে তিনজন স্ট্রংগেস্ট নির্মাতা ওই সময়ের তিনটা ছবি বানাচ্ছেন। তিনটা ছবিতেই পিতা চরিত্রের মধ্যে সাংঘাতিক একটা মিল আছে। আর্কেটাইপ একটা মিল। ‘মুসলমান চরিত্র’ আছে ওখানে। যে মুসলমান খুবই ডিবেটেবল। যে মুসলমান খুবই প্রশ্নবিদ্ধ মুসলমান। যে একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টাইট মুসলমান। বাবা চরিত্র যেটা। আনুর বাবা ছিলো মাটির ময়নাতে। লালসালুতে মজিদ ছিলো। বৃষ্টিতে ছিলো সম্ভবত আলী যাকের চরিত্রে। এই তিনটা চরিত্রের মধ্যে ওই তিন নির্মাতার ৭০ দশকে বেড়ে ওঠার একটা প্রচণ্ড প্রভাব আমি পাই। ৬০’র দশকে আমরা যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কনস্ট্রাক্ট করছিলাম, স্বাধিকার আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য, সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটা ছায়া কিন্তু ৭০ দশকে এসে তাদের মধ্যে পড়েছে। যেটার মধ্যে পশ্চিমা ইন্ডিভিজ্যুয়ালিজমের একটা চাপ আছে। পশ্চিমমুখীতার একটা চাপ আছে। যে চাপটার ব্যাপারে আমি খুবই কেয়ারফুল হয়ে গিয়েছিলাম, কনসাস হয়ে গিয়েছিলাম। আমার প্রশ্ন ছিলো, কেনো তিনজন গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতা ২০০১-২০০২ সালে তিনটা ছবি বানালেন এবং এর মধ্যে একটা চরিত্র একইরকমভাবে নেগেটিভ। পিতা চরিত্রটি মুসলমান চরিত্রকে উপস্থাপন করছে, যাদের সাংঘাতিক ডিবেটেবল একটা পজিশন আছে। যেটা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র লালসালু নিয়ে এখনো ওপেন ডিবেট চলছে।

আপনারা হয়তো দেখেছেন কবি সাজ্জাদ শরীফ-এর একটা টক—কয়েকদিন আগে দেখলাম ইউটিউবে—‘লালসালু’ নিয়ে ওয়ালীউল্লাহর ধর্ম পাঠের একটা ডিবেট চলছে। ওই জায়গা থেকে আমি সাবকনসাসলি, আনকনসাসলি কেয়ারফুল ছিলাম। আমি বোঝার, জানার চেষ্টা করছিলাম, আমি কে এবং আমার ন্যারেটিভটা কী হবে। আমি আমার ন্যারেটিভটা শুরু করতে গিয়েই আরেকটা ঘটনা দেখলাম। যেহেতু ওই পরম্পরার উত্তরাধিকার হিসেবেই স্বাধীনধারা চলচ্চিত্র আন্দোলন—মানে আপনি যেভাবে বললেন, যেটা আমি বলছিলাম—সেখান থেকে আমি যখন দেখতে পাচ্ছি যে, পশ্চিমামুখী চলচ্চিত্র চর্চা, উৎসবমুখী যে চর্চা, যেটা আমি নিজে একদম সাংঘাতিকভাবে করছি, তার শুরুটা আমার মধ্যে কোথা থেকে হয়েছিলো? সেই প্রশ্নটা আমার মধ্যেও জাগে। আজকে সকালে আমি আর সারা [সারা আফরীন] ডিবেট করছিলাম, আমাদের এই উৎসবমুখী চলচ্চিত্রের ধারণাগুলো কে দিলো? বা তারা কী রকম ছবি চায়? আমরা কী সেটা ফিটিং করি? নাকি আমাদের ছবিগুলো যেভাবে ফিটিং হবে সেই ছবিগুলোই বানাই। নাকি আমার ছবি নিয়ে স্ট্রাগল হয়; যেই কারণে আমার একটা ছবি নিয়ে ভীষণ স্ট্রাগল হয়েছে—অন্যদিন...। নতুন ছবিটা। এটা অ্যাকোর্ডিং টু সারা, আজকে বলছিলো, শুনতে কি পাও সিনেমাটা সম্ভবত ফেস্টিভালের বিষয় হইছে কারণ এটা ওরা একটা ফরমেটে ফেলতে পারছে ক্লাইমেটের পারসপেক্টিভে। যদিও আমি এই ছবিটা ক্লাইমেটের পারসপেক্টিভে বানাই নাই।

ক্লাইমেট হলো একটা উছিলা, ম্যাজিক। ম্যাজিক দেখানোর জন্য উছিলা দেখায় না? যেমন এই যে ম্যাজিক দেখাচ্ছি। ছবি তো ম্যাজিক। আপনাকে গল্প বলার জন্য আমি একটা ম্যাজিক অ্যাডপ্ট করছিলাম। ক্লাইমেট ইজ নট লাইক দ্যাট। বরঞ্চ আল মামুন [আ-আল মামুন] ভাই একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিলেন, দক্ষিণবঙ্গে তো ভয়ঙ্কর ক্রিটিকাল ঘটনা ঘটে গেছে—লবণ চাষ, চিংড়ি চাষ, ঘের-এটা নিয়ে তো গোটা জনপদ চেঞ্জ হয়ে গেছে। এবং জনপদ চেঞ্জ মানে আগামী ৫০ বছরের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া হয়েছে। চিংড়ি এক্সপোর্টের নামে উই ডেস্ট্রোয়েড আওয়ার হোম, হ্যাবিটেশন। সে জায়গাটা ছবিতে আনা হয়েছে। এজন্য এটা পরিষ্কারভাবে আলাপ করছি। ওইটার জন্যই আমি লিটারেচারের অপেক্ষা করছিলাম। নিশ্চয় একটা অসাধারণ উপন্যাস লেখা হবে, কীভাবে রপ্তানিমুখী বাণিজ্য করতে গিয়ে-সাময়িক কয়েকটা ডলার যেটা কিনা আল্টিমেটলি আমাদের কারোর পকেটেই আসে না; তার অন্তত ১০০ গুণ দামি জিনিস, ১০০ বছরের সাসটেইনেবিলিটি বিক্রি করে দিচ্ছি। আল মামুন ভাই কিন্তু সেটার একটা ইঙ্গিত করছিলেন। এই জনপদের গল্প এই ন্যারেটিভটা বলতে গিয়ে ক্লাইমেটকে আমি উছিলা করছিলাম, উৎসব সেটাকে পিক করে থাকতে পারে। অন্যদিন... নিয়ে যে কারণে অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে উৎসবে। কিন্তু যেসব উৎসব অন্যদিন... নিয়েছে, তারা রিপিটেডলি অন্যদিন... নিয়েছে। যেমন, ইডফার [ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভাল অ্যামস্টারডাম] মতো জায়গায় শুনতে কি পাও নিয়ে একটা ডিবেট হয়েছিলো, যখন আমি শুনতে কি পাও দেখিয়েছিলাম ওখানে। তখন বলেছিলাম, এটা কিন্তু ডকুমেন্টেশন বানাইনি আমি। কারণ এটা কোনো ডকুমেন্ট না। এটা প্রামাণ্যচিত্র না যে, কোনো কিছু প্রমাণ করার জন্য বা কোনো কিছু সাব্যস্ত করার জন্য করা হয়েছে। এটা একটা ন্যারেটিভ। এটায় আমি আমার জনপদের একটা গল্প নিয়ে আসছি। এটা নিয়ে ওরা রিয়্যাক্ট করেছিলো।

কিন্তু অন্যদিন... যখন আমি দেখাতে গেছি, তখন ওরা আবার এটাকে সেলিব্রেট করেছে। তুমি তো নিশ্চয়ই বলবে যে, তুমি ডকুমেন্টারি বানাওনি। ইয়েস, আমি ডকুমেন্টারি বানাইনি। ‘Tuschinski’  থিয়েটারে—১,২০০ না ১,৪০০ সিটের থিয়েটার—সেখানে মেইন কম্পিটিশনে দেখানো হয় ছবিটা। পৃথিবীর সো কলড সুন্দরতম থিয়েটার এইটা। নাম্বার ওয়ান থিয়েটার। নেটে দেখলে পাবেন। সেখানকার কম্পিটিশনে ১২টা ছবির মধ্যে এটা কম্পিট করেছে। এ রকম একটা ফেস্টিভালে দেখানো হয়েছে, ডেপুটি পরিচালক আমাকে স্টেজে প্রেইজ করেছে। তার মানে তখন তাদের মাইন্ড চেঞ্জ হয়েছে। প্রথমে যেটাকে ক্রিটিসাইজ করেছিলো, সেটাকে আবার প্রেইজ করেছে। সেইখান থেকে মমি’তে [মিউজিয়াম অব দ্য মুভিং ইমেজ, নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত মিডিয়া মিউজিয়াম] পিক করেছে; মমি থেকে আবার আরেক জায়গায় নেওয়া হয়েছে। যারাই এক জায়গায় ছবিটা দেখেছে, দেখে বুঝেছে, আরেক উৎসবে তারাই পরে পিক করে নিয়েছে। তারা কন্টিনিয়াসলি পিক করে নিয়েছে। কিন্তু শুনতে কি পাও সবাই পিক করেছে। কারণ তাদের কাছে ক্লাইমেট চেঞ্জের ব্যাপারটা অ্যাক্সেসেবল হয়ে গেছে। গ্লোবাল ইস্যুজ, থার্ড ওয়ার্ল্ড ফিট-ইন করে। এই যে ফিট-ইন করার যে ব্যাপারটা—আমি একজন নির্মাতা হিসেবে স্টেজে বসে দায় নিয়ে কথাটা বলতেছি—এখানে বিরাট অঙ্ক আছে। এবং এই বিরাট অঙ্কটা আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। তবে আমি কেয়ারফুল থাকার চেষ্টা করতে গিয়ে খুবই প্রবলেমের মধ্যে আছি। আমাদের আশপাশের সমসাময়িক এই মুহূর্তের প্রত্যেক নির্মাতা ওই ট্র্যাপের মধ্যে আছে—আমি দেখতে পাচ্ছি। সেইটা কীভাবে হয়েছে এইটা আমি জানি না। কেনো আসছে, কী জন্য আমি করেছি সেটা বলছি। কেনো মেকানিজম শিফট করার চেষ্টা করছি, সেটাও আমি বলছি। একটু জটিল উত্তর হয়ে গেলো প্রশ্নটার জন্য। কিছু করার ছিলো না আসলেই।

মমিনুল ইসলাম : আমার নাম মমিনুল; গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে মাস্টার্সে পড়াশোনা করছি। আপনার সিনেমাটাকে আমি প্রামাণ্যচিত্র কিংবা কাহিনিচিত্র এর কোনোটা হিসেবেই নিচ্ছি না। এবং আপনি যেহেতু বললেন, এইটা আমি ভিন্নভাবে তৈরি করতে চেয়েছি। আপনার সিনেমা যে ল্যাঙ্গুয়েজটা তৈরি করেছে, ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে একরকম সামগ্রিকের দিকে যাত্রা, এটাকে আমি বাহবা-ই দিচ্ছি। যদিও সবাই অনেক রকম কথা বলতেছে সিনেমাটা নিয়ে। আমি আপনার দুটো সমালোচনাও করতে চাই এতোকিছুর মধ্যে। আপনি দেখালেন একটা গল্প, কিন্তু ন্যারেটিভের বাইরেও আরো হাজার ন্যারেটিভ থাকে। কিংবা ধরেন, শুনতে কি পাও-এ যেটা প্রথমে দেখছিলাম, সেখানে ঘূর্ণিঝড়কে আপনি উছিলা আকারে ধরছেন। সেখানে আপনি একটা পরিবারকে হয়তো উপস্থাপন করতে চাইছেন। সেই পরিবারের কাহিনির বাইরেও অনেক কাহিনি থাকে। যেটা আসলে উঠে আসতে পারতো কি না? এবার একটু নীল মুকুট-এর কথাই বলি। নীল মুকুট-এ যেটা দেখাচ্ছে—আমার পাড়াতেই দেখেছি এই রকম বিদেশে মিশনে গেছে যেসব নারী, তাদেরকে একদম নাক সিটকানো বা এভাবে দেখা হচ্ছে যে, ওরা পরিবার ছেড়ে এইভাবে বিদেশে গেছে! অনেকেই একরকম খোটা দিয়ে বলতো, এরা ‘মর্দানি’। এই রকম একটা নেতিবাচক অর্থ তারা তৈরি করতো সামাজিকভাবে। এইটা কিন্তু আমরা ফেলে দিতে পারি না। এসব বিষয় সিনেমাতে আসতে পারতো কি না? কিংবা এসব ন্যারেটিভের বাইরে যেসব ন্যারেটিভ আছে, সেটা সিনেমাতে আসতে পারতো কি? নির্মাতা হিসেবে আপনি সেটাকে কোনোভাবে অ্যাভয়েড করার চেষ্টা করেছেন কি না?

আমার সিনেমা নিয়ে লেখালেখি করার জায়গা থেকে বলছি, আপনি কাহিনিচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রের মাঝখান দিয়ে এই যে নতুন একটা সিনেমা ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাবলিশ করতে চাচ্ছেন, নিঃসন্দেহে এটা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু আপনার এই ন্যারেটিভের পেছনের যে ন্যারেটিভ, এসব আরো খোলামেলাভাবে দৃশ্যায়ন করা যেতো কি না? এইখানে আপনার কাছে আমার আসল প্রশ্ন।

কামার : আপনি তো সমালোচনা করেননি [হেসে]। আপনি তো খুবই সুন্দর এবং জরুরি একটা প্রশ্ন করেছেন। উত্তরটা আমার দিক থেকে এমন—সিনেমা বা কোনো ক্রিয়েটিভ কাজই নৈর্ব্যক্তিক না, সাবজেক্টিভ। এটা কিন্তু যেকোনো ক্রিয়েটিভ কাজের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। আমার একটু হেল্প হবে আপনি আই কন্টাক্ট করলে, ঠিক আছে [প্রশ্নকারীকে উদ্দেশ করে]? আমার মনে হচ্ছে, স্ট্রাগল করতেছি আমি। অবজেক্টিভিটি রিসার্চের কাজ, পত্রিকার কাজ, আলোচনার কাজ, থিসিসের কাজ। সিনেমা এগুলোর কোনোটাই না। সিনেমা হচ্ছে আমার অত্যন্ত ব্যক্তিগত একটা ‘পয়েন্ট অব ভিউ’ (PoV)। যেটাকে টেকনিকাল লাইনে আমরা বলি পি ও ভি চেঞ্জ করো। আপনি আমার দিকে তাকিয়ে কিন্তু আমার পেছনকার দিকটা দেখতে পাচ্ছেন। আমি কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না। আবার আমি আপনার দিকে তাকিয়ে আপনার পেছনের দিক দেখতে পাচ্ছি; যেটা আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। এইটা হচ্ছে আপনার পয়েন্ট অব ভিউ। আর ওইটা হচ্ছে আমার পয়েন্ট অব ভিউ। এই পয়েন্ট অব ভিউয়ের ডিফারেন্স থাকাটা কিন্তু খুবই স্বাভাবিক ও জরুরি।

ছবির ক্ষেত্রে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার পয়েন্ট অব ভিউ যেটা, আমি শুধু সেইটাতেই মনোযোগ দিবো। তার পাশাপাশি আনুষঙ্গিক যা আসবে; সেটা কতোটুকু আসতে পারে বা কতোটুকু আসবে, সেটা স্বাধীনধারার নির্মাতা হিসেবে দেখানোর রাইটস আমার আছে। একইসঙ্গে দর্শক হিসেবে আপনার যদি কোথাও খামতি মনে হয়, সেইটাও ডিসকাস করার রাইটস আপনার আছে; কিংবা সেইটা নিয়ে ক্রিটিসাইজ করার রাইটস আপনার আছে। আমরা কেউই এখানে কোথাও কম না। কিন্তু আপনি যদি বলেন, এই জিনিস বা এগুলো আনলে এটা কমপ্লিট হতো, তাইলে আমার সিরিয়াস ক্রিটিসিজম আছে। কমপ্লিট করার দায়িত্ব আপনাকে বা আমাকে কে দিয়েছে? আমরা পৃথিবীর কোন যুধিষ্ঠির, যে কিনা বলে দিবো এইটাই হচ্ছে ঠিক, আর এইটাই হচ্ছে ভুল! এই চিন্তাটার মধ্যেই ঝামেলা আছে। যখন দুই বন্ধুর মধ্যে ঝগড়া করবেন আর ঝগড়া শেষে ভাববেন, ও ঠিক বলছে কোনো এক জায়গা থেকে। যতোক্ষণ ওইটা আপনি বুঝতে না পারবেন, ততোক্ষণ বন্ধুকে বুঝতে পারবেন না। প্রেমিকাকেও বুঝতে পারবেন না। বুঝাতে পেরেছি?

আরেকটা কথা বলি। আপনি খুবই ইন্টারেস্টিং একটা শব্দ ইউজ করেছেন—‘মর্দানি’। মার্দ বলে একটা ছবি হয়েছিলো অমিতাভ বচ্চনের। জানেন? ওটা খুবই বিখ্যাত ছবি ছিলো। ওখানে বাবা বুকে চাকু দিয়ে লিখে দেয় ‘মার্দ’। এম এ আর ডি। মর্দ হাঁটিয়া যায় রে। সেন্টেন্সটা আছে, বাংলা লিটারেচারে পাবেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আইডিয়া। আমি একটু হাস্যরস করে বললাম। কিন্তু আইডিয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং চিন্তাটা খুবই জটিল। আমার কথায় অনেক ফেমিনিস্ট রাগ করতে পারে। তবে আমার কাছে কেনো জানি মনে হয় পৃথিবীটা মর্দানি না। পৃথিবীটা নারীময়ী, নারীকেন্দ্রিক। এখন এইটা আবার যদি আমাদের দেশি দর্শনের কাছে ফেরত যাই, সে তো পরিষ্কারভাবেই মা, মাটি অনেকভাবেই এক্সপ্লেইন করছে। যদি এখন এই মুহূর্তে নিজের ব্যক্তিকেন্দ্রিক, আমার নিজের ছোট্ট পরিবারটার দিকে তাকাই, তখন আমি দেখি, আমার কেন্দ্রটা কোথায়, সেটা পরিষ্কার দেখতে পাই। সেন্টার অব দ্য সার্কেলটা আমি খুব পরিষ্কার দেখতে পাই। তাহলে ব্যক্তি থেকে এই সমষ্টি পর্যন্ত আমাদের যে আইডিয়া, নারীর যে কনস্ট্রাকশন, এটা নিয়ে আমার মনে হয় একটু চিন্তা করা উচিত।

একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে শেষ করছি। আমাদের এখানে সো কলড হাইব্রিড বীজ আসার আগ পর্যন্ত কৃষাণীর কাছে বীজ জমা থাকতো সারাবছরের। কৃষকের সঙ্গে ওই বীজের কোনো সম্পর্ক ছিলো না; একটু খোঁজ নিয়ে দেখবেন। কৃষক জমিতে যায়, ধান পুঁতে দিয়ে চলে আসে। অনেক ফেমিনিস্ট আমাকে এখন ক্রিটিসাইজ করতে পারেন। তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আমি আমার মূল উক্তিতে ফিরে আসতেছি। কৃষাণী, ওই যে তার কাছে বীজ ধান রাখা আছে ওটার পাওয়ার কিন্তু ম্যাট্রিয়ার্কি তৈরি করেছে সমাজে। এবং এই সমাজের বিবর্তনে আমি এই অ্যানথ্রোপসিন যুগের কথা বলতেছি না। ১০,০০০ কিংবা ১২,০০০ বছরের আগের হিস্ট্রিতে সব সমাজেই এটা কম বেশি ছিলো, যখন থেকে কৃষিভিত্তিক সমাজ হয়েছে। সেই মর্দ বা মর্দানি বা মার্দ, এই ব্যাপারটা কোথা থেকে শুরু হয়েছে? আমি উত্তর দিই নাই। প্রশ্ন করলাম আপনাকে। উত্তরটা খুঁজে দেখা জরুরি। পাশের কেউ পুলিশে যদি চাকরি করতে যায়, বা কোনো পুলিশকে যদি কেউ মর্দানি বলে বা তাকে ট্যাগিং করার চেষ্টা করে, তাহলে সেটার জন্য নিশ্চয় একটা উদ্দেশ্য বা রাজনীতি আছে বা থাকতে পারে। কিন্তু পাতি রাজনীতি বলে এটাকে খুবই তাড়াতাড়ি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে রাজি না বলেই আমি অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছি। মানে এটাকে আমি খুবই হালকা করে দেখতে রাজি না। একটু ক্রিটিসাইজ করলাম। আপনি করলেন না আমাকে!

সালাউদ্দিন নীল : ধন্যবাদ। আমি সালাউদ্দিন নীল। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। আসলে আপনার শুনতে কি পাও সিনেমাটা দেখে আপনাকে আমার একজন নৃবিজ্ঞানীই মনে হয়েছে। আর এই সিনেমা দেখার পরে একটু ঘেটে আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে পারলাম, আপনি আর্কিটেকচার নিয়ে পড়ালেখা করেছেন। এটা দেখে আসলে যে কেউ চমকায় যাবে। দুইটা দুই রকম ডিসিপ্লিন হয়ে গেছে আরকি। আপনার কাছে আমার প্রশ্নটা হলো, আমি ২০১৪ সালে আই সি ডি ডি আর, বি’তে [ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়া ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ] জব করতাম। আমি নিজে থেকেছি ওই কমিউনিটিতে। আমি দুই মিনিটের একটা ডকুমেন্টারিও তৈরি করেছিলাম। যেটা গ্র্যান্ড চ্যালেঞ্জ কানাডা থেকে দুই কোটি টাকার প্রাইজ পেয়েছিলো। আসলে তাদের ওই কমিউনিটিতে থেকে, তাদের যে রিমোট এলাকা, সেখানে আমার কাজের অভিজ্ঞতা আছে। আপনি নির্মাতা হিসেবে সফল, সবাই আপনার সুনাম করতেছে বা আপনি যেভাবে কাজটা তুলে নিয়ে এসেছেন, এটা পুরাই অ্যানথ্রোপলজিকাল কাজ হয়ে গেছে। আপনি বাইরে এটা অনেক জায়গায়, অনেক দেশে দেখিয়েছেন। সেইক্ষেত্রে যে কমিউনিটি নিয়ে কাজ করেছেন, আপনার দ্বারা তারা কোনোভাবে বেনিফিসিয়াল হয়েছে কি না? এতো এতো বিদেশে এটা সাবমিট করেছেন আপনি। ২০১২-তে এটা রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কারও পেয়েছে। রাষ্ট্র তাদের জন্য কোনো কিছু করেছে কি? বা আপনার থ্রুতে কোনো লিঙ্কে তারা কোনো ধরনের উপকার পেয়েছে কি না? এইটা আমার জানার খুবই আগ্রহ ছিলো আরকি।

কামার : প্রথমত, আমাকে নৃবিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। যদিও আমি নৃবিজ্ঞানী হিসেবে নিজেকে দাবি করার কোনো রকম যোগ্যতা বা এখতিয়ার রাখি না। দ্বিতীয়ত, নৃবিজ্ঞান নিয়েও কিন্তু একটা ক্রিটিকাল ক্রিটিসিজম আছে। সেই কারণে আমি ওখানে খুব কমফোর্টেবল ফিল করবো না। পুরো ৪০০ বছরের কলোনিয়াল হিস্ট্রিতে নৃবিজ্ঞান কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এবং সার্ভে সায়েন্স কিন্তু অন্যতম একটা মাধ্যম ছিলো। এইখানে হিস্ট্রিটা খুবই ডিবেটেবল। বা এখন হয়তো আর্গুমেন্টেড। কয়েক বছর পর হয়তো নাও থাকতে পারে এটা, পরিষ্কার হয়ে যেতে পারে। ওই জায়গায় আমার একটু ডিসকমফোর্টও আছে। আর তৃতীয়ত হচ্ছে, আপনি যেটা বললেন সেটা ঠিক, ২০১২ সালের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার না, ২০১৪ সালে সম্ভবত। কারণ ছবিটা বাংলাদেশে রিলিজ করতে পেরেছিলাম ২০১৪ সালে। দুই বছর পরে রিলিজ হয়েছিলো। কিন্তু ২০১২ সাল মানে ‘১২ সালের শেষের দিকে গিয়ে এটার প্রিমিয়ার হয়েছিলো। তার পর দুই বছর ধরে ছবিটার স্ক্রিনিং, এখানে স্ক্রিনিং করার নানারকম হ্যাপা সামলাতে হয়। সেই হ্যাপা সামলিয়ে দেখাতে পেরেছি। আমি মনে করি সেই হ্যাপা আজকে এই মুহূর্তে এখানে বসেও আমাকে সামলাতে হচ্ছে, ছবিটা দেখানো নিয়ে। কারণ এটার জন্য তো প্রচুর হ্যাপা সামলাতে হয়।

এটা সত্যিকার অর্থেই—আপনি যেটা বললেন, দুই মিনিটের ছবিতে দুই কোটি টাকার কথা—আমি এখন পর্যন্ত ১০ বছরের মধ্যে তার ধারেকাছেও যাইনি। মানে আমার পাঁচখানা ছবি শ্যুট করেছি, কিন্তু এর ধারে কাছেও আমি যেতে পারি নাই ফাইন্যান্সিয়ালি। বরঞ্চ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, আমাকে এখনো প্রায় মাটি কাটতে যেতে হয়। মাটি কাটা একটু রূপক অর্থে বললাম। মানে দেখবেন রাতে ট্রাকে ২০-৩০ জন মানুষ গামছা প্যাঁচায়ে কাজ করতে যায়। তারা কোথায় যায়, কেউই কিন্তু জানে না। কী করতে যায়, কেউই কিন্তু সেভাবে জানে না। সারারাত মাটি কেটে কিছু টাকা নিয়ে আবার চলে আসে। আমাকেও মাটি কাটতে যেতে হয় আরকি। ইদানীং সেভাবে যেতে হচ্ছে না। আমার যিনি সহধর্মিণী, উনিই ইদানীং মাটি কাটছেন। মাটি কেটেই কিন্তু আমাদের এখানে আসতে হয়েছে। আমি যে আজকে এখানে তেলটা পুড়িয়ে আসছি, সেটা মাটি কাটার পরেই কিন্তু সম্ভব হয়েছে।

চতুর্থত, আপনার প্রশ্নের উত্তরটা হচ্ছে, কোনো একটা কমিউনিটির জন্য আমি ছবিটা বানাইনি। কমিউনিটির অনুমতি নিয়ে, তাদের কাছে অ্যাক্সেস নিয়ে, তাদের সঙ্গে থেকে, তাদের সঙ্গে ওই জায়গাটায় পৌঁছায়ে কাজটা করতে হয়েছে। মানে আমার তিন বছর সময়টা ওখানেই লেগেছে! কীভাবে বিশ্বাস করানো যায়, মানে অ্যালাউ করার জন্যেও কিন্তু আমাকে তাদের বিশ্বাস করা লাগবে। যেমন, আমি ওখানে যখন থাকতাম, আমি কোথায় থাকতাম? আমি ওইখানেই থেকেছি। ওইখানকার পানি খেয়েছি। ওইখানে আমি গোসল করেছি, ওইখানে আমি টয়লেট করেছি। এবং ওইখানে আমাকে প্রত্যেকবার গিয়ে টয়লেট বানাতে হতো। ওদেরটা ইউজ করতাম না। এবং আমাদের সঙ্গে যারা যেতো, ওরা কিন্তু যেখানে সেখানে গিয়ে বসতে পারতো না। কিন্তু ওরা [কমিউনিটির মানুষজন] ভোর রাতে নদীর আশপাশে গিয়ে বসে পড়তো। মানে তখন এমন করতো। এখন চেঞ্জ হতে পারে। আমাদের টিমকে হাজার পিটাইলেও তারা ওইটা করতে পারবে না। এজন্য প্রথমে গিয়েই চারটা খুঁটি পুততে হতো, একটা প্লাস্টিকের বেড়া দিতে হতো, গর্ত করা লাগতো। সবকিছু ঠিকঠাক করতে আমার দুই থেকে তিনদিন লাগতো—মানে জায়গাটাতে বসতে। তারপর হচ্ছে খাওয়াদাওয়া। যেমন, একদিন একজন আমাকে জিজ্ঞেস করছে এখানে হাঁস, মুরগি বা গরু দেখলাম না যে। ওখানে তো সেভাবে কিছু নাই। ওই গ্রামে দুইখানা হাঁস ছিলো, সেটা ছবিতে দেখানো হয়েছে আরকি। খুব ছোট্ট করে, বৃষ্টির জায়গায় ছোট্ট দুইটা হাঁসকে দেখানো হয়েছে। এছাড়া আর কোনো হাঁস, মুরগি কিচ্ছু নাই! মানে ওই সময় ছিলো না। এবং আমাকে অ্যাকচুয়ালি বাইরে থেকে বাজার করে নিতে হতো। বাজার কী রকম? টিনের মধ্যে নোনা ইলিশ নিয়ে যেতাম। থাকবে, নষ্ট হবে না। সাত দিন, ১০ দিন থাকবে। ডিম নিয়ে গেছি। থাকবে ওটাও। মানে শুধু জাউ খেয়ে থাকতে হয়েছে কয়েকদিন। কারণ বাজার শেষ হয়ে গেছে, টাকাও শেষ হয়ে গেছে, সময়ও শেষ হয়েছে কিন্তু কাজটা আর শেষ হয়নি।

আপনারা যেটা শেষে দেখছেন—চাপান। হাসি পাচ্ছে? ব্যাপারটা হাসির না, ওটা সত্যি। দেখেন, চাপান যে ব্যাপারটা, একেবারে শেষে যে মাটি চাপা দেয় না একটা শটে, যখন পানিটা বন্ধ হয়। ওইটার জন্য আমি এক বছর ধরে বসে আছি, ওরা চাপান দিবে আর আমি সেটা তুলবো। এটা আমার স্ক্রিপ্টের খুবই ক্রিটিকাল জায়গা। চাপানটা তুলতেই হবে। এই মাস, ওই মাস করে করে হয়-ই না। কারণ এটা আমার ইচ্ছে না তো! এটা প্রকৃতিনির্ভর। পানি, জলবায়ু, বাতাস, জোয়ার-ভাটা, চাঁদ অনেক কিছুই এর সঙ্গে জড়িত। এই করবো, ওই করবো। আমি যখন এদের এখানে কাজ শুরু করি, তার প্রায় এক বছর আগে ওরা একটা বাঁধ দিয়েছিলো, সেই বাঁধটা কিন্তু ভেসে গেছে। আমি যখন শুরু করি, ওইটা ভেসে যাওয়ার পর থেকেই শুরু করি। নেক্সট বাঁধটা ওরা দুই বছরের মধ্যে দিতে পারে, আবার পাঁচ বছরেও না দিতে পারে। এ রকম একটা অবস্থা। এই রকম আনসার্টেইন জায়গা থেকে আমি শুরু করেছিলাম। সেই জায়গায় একদিন একজন জানালো, দাদা চলে আসেন, চাপান দিবো। কবে দিবেন? সামনের সপ্তাহে দিবো। তখন আমি চলে গেছি তাড়াতাড়ি। ওরা এক সপ্তাহের কথা বলেছে, আমি ১০ দিনের প্রিপারেশন নিয়ে চলে গেছি। খাওয়াদাওয়া, চাল-ডাল নিয়ে। তাড়াহুড়া করে চলে গেছি, ওখানে গিয়ে চাপান তুলবো। মনে করেন, রুপসা ঘাটে নামছি, সেখান থেকে চার ঘণ্টা ট্রলার ঠেলে যেতে হয়েছে। বা চালনা ঘাটে নামছি সেখান থেকে তিন ঘণ্টা ট্রলার ঠেলে যেতে হয়েছে। অবশ্য এটা যদি ভাটা থাকে তাহলে। আর যদি জোয়ার থাকে তাহলে সাড়ে চার ঘণ্টা লাগছে। কারণ ভাটা হয়, জোয়ার থাকে, এজন্য পানি উঠানামা করে। একবার পানি উঠতেছে, আবার নামতেছে। আর আমরাও একবার উঠি, আরেকবার নামি। ইঞ্জিনে যতোই পাওয়ার দেয় নৌকা আর চলে না। মানে বিচিত্র সব কাণ্ডকারখানা!

এইসব করে করে ওখানে পৌঁছানোর পর ওরা বলছে, এক সপ্তাহের মধ্যেই চাপান দিবে। কিন্তু ১০ দিন পার হয়ে গেছে, চাপান আর দেয় না। আমাদের রসদও শেষ হয়ে যাচ্ছে। ১৫ দিন শেষ হয়ে গেছে, চাপান নাই। ২০ দিন শেষ হয়ে গেছে, চাপান নাই। যখন জিজ্ঞেস করি, এই তো দিবো বলেই আকাশের দিকে তাকায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে পানি দেখে আর বলে, এইতো দিবো। দুই দিন পরেই দিবো। আকাশ দেখে, পানি দেখে—দুই দিন পর মানে কী? আমি আর্কিটেক্ট, জ্ঞানী মানুষ, আমি তো আলে-বিলে-খালে পাশ! এরা তো সব ‘অশিক্ষিত, ‘চাষা’—এ ধরনের কিছু শব্দ বানিয়েছি আমরা এদের জন্য। গালি হিসেবে ব্যবহারের জন্য। আমরা আর্কিটেকচার পড়ি, অ্যানথ্রোপলজি পড়ি; দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াই। কিন্তু ওরা পানি দেখে বলে দিয়েছে আমাকে—হবে না। আর যেদিন হয়েছে, সেদিন বলে নাই! পানি দেখে ওরা বস্তা ফেলা শুরু করে দিয়েছে। আমি অ্যাক্সিডেন্টালি সেখানে গিয়ে পৌঁছেছি। এবং সেটা প্রায় এক মাস পরে, যখন আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ। রসদ শেষ। এই রকম একটা জায়গায় গিয়ে ওই চাপানটা হয়েছে। এবং আমরা জানতাম না, সেদিন চাপান হচ্ছে। আমরা একটা অন্য শুটিং করতেছিলাম। এটা হচ্ছে কমপ্লিট অ্যাক্সিডেন্ট। আই কুড হ্যাভ মিসড ইট।

আমার মূল বক্তব্য যেটা, তাহলে ছবিটা কি আমি এই কমিউনিটির জন্য বানিয়েছি? চারটা কমিউনিটির জন্য? নো, আমার আইডিয়া সেটা না। আমি এই জনপদটাকে বোঝার চেষ্টা করতেছিলাম। আমি কিছু প্রশ্ন নিয়ে এই জনপদের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। উত্তর আমার কাছে নাই। আমি কোনো প্রফেসি করতে বসি নাই। আমি কিছু কামাই করতেও বসি নাই। আমি যে সময়টায় জন্মাইলাম, একটা বদ্বীপে জন্মাইলাম। যার রাষ্ট্র, যার ভূগোল, যার ধর্ম, যার সমাজ আমি কিছুই বুঝছি না। সেই জন্য ওই জনপদগুলোই আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। সেই জন্য আমি ওই কমিউনিটিতে গিয়েছি এবং আমার মনে হয় টু সার্ভ দ্য কমিউনিটি, বিগারলি। আমি জনপদটার এক্সপেরিয়েন্স, সারা বাংলাদেশের দর্শন এবং বাংলাদেশের একটা গল্প আপনার কাছে আনার চেষ্টা করেছি মাত্র। এখন ফেইল করলে মাফ চাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। একটা জনপদকে, ওদের ওখানে কিছু টাকা দিয়ে, একটা স্কুল বানিয়ে দিয়ে, মানে সেগুলো আমি অন রেকর্ড বলতে চাচ্ছি না। সেইগুলো আমি বলবো না এখানে। বলে সেগুলোর কৃতিত্বও আমি নিবো না। কিন্তু আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, আমি তো ওই জন্য বানাইনি এই ছবিটা। আপনার কাছে আমি এই প্রশ্নটা নিয়ে আসতে চেয়েছি, যে উন্নয়ন রেটোরিকের মধ্যে আমরা বসবাস করি, সেখানে এর রিপ্রেজেন্টেশন কোথায়? আমি রাগ করি নাই, একটু ইমোশনাল হয়ে কথা বলছি [দর্শকের করতালি]।

পুশরাম চন্দ্র : আমরা সবাই সিনেমাটা দেখলাম। দেখতে গিয়ে আমার কিছু জায়গায়, ঠিক কিছু জায়গায় না, শুধু একটা জায়গায় কনফিউশন। দুইটা সিনেমাতেই একটা ব্যাপার আছে, শ্যুটগুলো এমনভাবে করা হয়েছে—আমার কনফিউশন—সেট ডিজাইন করে করা নাকি অ্যাজ ইউজাল করা?

কামার : নির্দ্বিধায় এবং নির্ভয়ে বলেন। আপনি দর্শক। ইউ আর দ্য মোস্ট এমপাওয়ার্ড পারসন হেয়ার।

পুশরাম : আচ্ছা। আমার কথা হলো ক্যামেরার কাজ নিয়ে, বা আপনার ক্যারেক্টার যারা ছিলো তাদেরকে নিয়ে। আমার দেখতে গিয়ে কনফিউশন হচ্ছিলো, যারা ক্যামেরার সামনে আছে, তাদেরকে কোনোভাবে সেট করা কি না? আমরা যেটা দেখি আর কি—নায়ক-নায়িকা বা অ্যাকশন সবকিছুই আগে থেকে প্রি-প্ল্যানড, এখন শুধু করবে এ রকম। আমার প্রশ্নের জায়গা এটা কি এ রকম কিছু ছিলো? নাকি আপনি তাদের স্বাভাবিক যে ব্যাপারটা, সেটাই ক্যামেরায় ক্যাপচার করার চেষ্টা করেছেন। আর এটাই যদি হয়ে থাকে¾তাদের স্বাভাবিক চলন-বলন, তাদের কথাবার্তা, তাদের ইমোশন, এটা যদি ক্যাপচার করে থাকেন¾আমার কোথাও গিয়ে মনে হচ্ছে যদি কোনো সম্মোহনী ক্ষমতা না থাকে, কোনো অপেশাদার কাউকে দিয়ে এ রকম কাজ করানো সম্ভব না! ক্যামেরার সামনে যারা ছিলো তারা তো আসলে পেশাদার না।

কামার : এখন সবগুলো গুরু তথ্য, গুপ্ত কথা যদি পাবলিকলি এখানে বলে দিই, তাহলে কালকে থেকে আমার দোকান বন্ধ হয়ে যাবে [হাসি]। কিছু কথা থাক না গুপনে! আপনারা গুপনে শব্দটা শুনছেন। আমি কিন্তু ভুল করে বলি নাই। আমি গুপনে বলছি, গোপনে বলি নাই—কিছু কথা থাক না গুপনে। না, আমি দুষ্টামি করেছি। এটা টেকনিকাল প্রশ্ন। এটা খুবই অ্যাকাডেমিকাল প্রশ্ন। এটা এখন খুবই বোরিং হয়ে যাবে। আনটিল, এখানে কি আর কেউ এই প্রশ্নটার উত্তর জানেন?

দেখেন এখানে, শুনতে কি পাও-এ, পুরো ছবিতে কোথাও কেউ কোনো কিছু বলছে না। হঠাৎ করে বাচ্চাটা আমার দিকে তাকিয়ে বলছে, এই তোমার বাড়ি কোথায় গো? আমাকে নিয়ে যাবা? আমি বলছি, কালভার্টের পেছনে। তখন ও বলছে, এ মা, আমি না এই ক্যামেরা চালানো লোকজনের সাথে চইলে যাবো। ওর মা পরে বলছে, এই ‘ক্যামেরা চালানো’ না, বলো কাকু। তার পরও ও বলছে, না, আমি এই কাকুদের সাথে চইলে যাবো, তিন মাস থাকবো। আর কোনোদিন আসবো না। এই কনভারসেশনটা অ্যাক্সিডেন্টাল না কিন্তু। তাহলে এটা কি প্রেসক্রাইব? না। এটা কিন্তু প্রেসক্রাইবও না। আমি একটা ঘটনা বলে আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি; পুরোটা বললে অনেক লম্বা আলোচনা হয়ে যাবে। আমি এই জন্যই আপনাদেরকে বললাম, কিছু কথা থাক না গুপনে। এটা আপনার চায়ের আড্ডার প্রশ্ন। বুঝতে পারছেন? আসলে এখন অনেক রাত হয়ে গেছে। আমি অনেকক্ষণ ধরে হাঁসফাঁস করছিলাম। আমি ব্যাখ্যাটা দেবো না। এখানে শুধু একটা কথা বললাম, ওটা অ্যাক্সিডেন্টাল কিছু ছিলো না। এবং ওখানে ফোর্থ ওয়ালটা আসলে ইচ্ছা করে ভাঙছিলাম। ফোর্থ ওয়াল একটা কনসেপ্ট। গুগল করলে ইদানীং সব জানা যায়। জেনে নিবেন। ব্রেখটের [বার্টোল্ট ব্রেখট] একটা কনসেপ্ট ছিলো ফোর্থ ওয়াল নিয়ে। স্টেট হচ্ছে তিনটা ওয়াল নিয়ে। আর ফোর্থ ওয়াল হচ্ছে দর্শক। দর্শককে টান দিয়ে নিয়ে আসার একটা টেকনিক ওটাতে ব্যবহার করা হয়েছে। এবং কনসাসলি তাকে মনে করানোর জন্য যে, এটা কিন্তু একটা ছবি। বাকিটা আমরা আলোচনা করতে পারি পরে। বা এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের পেজ বা কোথাও একটা ভিডিও আসবে সামনে, ওখানে পাবেন।

‘কামারশালায় সিনেমাযাপন’-এর পেজে কয়েকদিন আগেই আমি বেশ কয়েকটা টেকনিকাল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। আপনার জন্যও বলে রাখলাম, ওই পেজে এই টেকনিকাল প্রশ্নগুলোর কয়েকটা উত্তর দেওয়া হয়েছে। আমি কিন্তু আলোচনা ছোটো করে নিয়ে আসছিলাম, আপনিই কিন্তু প্রশ্ন করে ফেললেন।

মাহমুদুল হাসান : যাইহোক, মমিন ভাই একটু আগে এমন-ই একটা প্রশ্ন করেছিলো। আমার প্রশ্ন অনেকটা এর কাছাকাছি। আমি মাহমুদুল হাসান। জার্নালিজমের থার্ড ইয়ারের শিক্ষার্থী। আমার প্রশ্নটা বলি, মমিন ভাইয়ের পরিপ্রেক্ষিতেই। আপনি তো বললেন, মমিন ভাইয়ের ক্রিটিক হয় নাই। কাজেই আমি যদি ক্রিটিক করতে পারি একটু। আপনি বার বার এস এম সুলতানের রেফারেন্স টানছিলেন। এস এম সুলতানেরই একটা কথা আছে, আমার দেশে কৃষক যতো বঞ্চিত হয়, আমার পেইন্টিংয়ে কৃষকের পেশি ততো শক্তিশালী, পেশিবহুল হয়ে ওঠে। এবং এটাকে যদি আমি পাঠ করি, তাহলে আমি সাবঅলটার্নের কনসাসনেস বিষয়ে পাঠ করতে পারি। কিংবা এক ধরনের আশা হিসেবেও পাঠ করতে পারি বা ভবিষ্যৎ। যেটা আ-আল মামুন স্যার বলছিলেন যে, এটা একটা ভবিষ্যতের বার্তা দেয়। আমার প্রশ্নের জায়গা হলো, আমরা যে ধরনের স্টেটের মধ্যে বাস করি, যে ন্যাশন স্টেট বা যে ধরনের বায়োপলিটিকাল স্টেটের মধ্যে বাস করি, এই স্বপ্নটা আদৌ সম্ভব কি না? দ্যাটস মাই কোয়েশ্চেন। আদৌ সম্ভব কি না? ইজ ইট পসিবল অর নট?

কামার : আচ্ছা, আচ্ছা। বুঝতে পারছি। প্রথমত, আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি যদি এস এম সুলতানের প্রসঙ্গটি বার বার এনে থাকি। এটা খুবই অ্যাক্সিডেন্টালি নিয়ে আসছি হয়তো। এটা প্রশ্নের মধ্যেই চলে আসছে। কারণ এখানে আজকে স্টেজে বোধহয় প্রসঙ্গটা কয়েকবার আলোচনা হয়েছে। সেইটা আসলে আমি ব্যক্তিগত জায়গা থেকে বলেছি। এটা আমার ব্যক্তিগত পছন্দ। এটাকে আমার রেফার করা উচিত হয়নি। এটা যদি আমি করে থাকি, আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। ঠিক আছে? আমি খুবই লজ্জিত এবং খুবই বিব্রতবোধ করছি। আর দ্বিতীয়ত হচ্ছে, সাবঅলটার্ন কনসাস জিনিসটা আপনি যেটা বললেন, আমাদের যে বায়োপলিটিকাল বাস্তবতা, সেই কথা আপনি বললেন, এই মুহূর্তে, বা জিওবায়োপলিটিকাল বললেন সম্ভবত কথাটা। এইটা আপনি যদি হিস্ট্রির রেফারেন্স রিড করেন, তাহলে ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে যাবেন। তবে আপনি যদি হিস্ট্রি রেফারেন্সে বলেন, পুরো জিনিসটাই কিন্তু সাবকনসাস। আমি যতোক্ষণ পর্যন্ত ভুলিয়ে রাখতে পারবো, ততোক্ষণই তো আপনার ওপর আমার ক্ষমতা। আপনার প্রেজেন্টে তো এইটাই সম্ভব হচ্ছে¾সবাই আমরা আমেরিকায় চলে যাচ্ছি। আমেরিকার ভিসা এনে দিলে নির্বাচন কমিশন টেনশনে পড়ে যায়। কাজাখস্তানের দিকে গেলে সেটা কিন্তু হতো না। হতো? হতো না। ইন্ডিয়াতে হতো। কিন্তু উত্তর কোরিয়া হলেও হতো না। মানে কোনটা এইদিকে পড়ে, আর কোনটা এইদিকে পড়ে না, সেটার একটা অঙ্ক, রাজনীতি, বা সমসাময়িক বাস্তবতা, অনেক কিছু কাজ করে।

এইটা তো সমসাময়িক বাস্তবতা। এখন বেগমপাড়ার গল্পটা কতোদিনের, কয় বছরের? সমস্যা তো বেগমপাড়া নিয়ে হয়েছে, না? কোনটা যে পাবলিক হবে আর কোনটা যে কী হবে, যা মন চাচ্ছে বলে দিচ্ছি! প্লিজ এইটা আমি অনেস্টলি ইন্টারেকশন করছি, বাকিটা নিজেরা সামলিয়ে নিয়েন। অন ক্যামেরায় বললাম। আমি অন ক্যামেরাতেই বলি। এইটুকু আমার রাইট আছে। বেগমপাড়ার হিস্ট্রি কয়দিনের? অথচ বেগমপাড়াই এখন রিয়ালিটি। ভিসা না পেলে আমি বিপদে পড়ে যাচ্ছি। পুরো সরকারব্যবস্থা, পুরো ব্যুরোক্রেসি এটা নিয়ে আছে। কেনো সেটা? ম্যাক্সিমাম ৩০ বছরের বেশি তো না বেগমপাড়ার বয়স। সেটা যে দেশেরই হোক। মালয়েশিয়ার হোক, কানাডা হোক। তার মানে এই রিয়ালিটিটা খুবই রিসেন্ট টাইমের। জিনিসটা সাবকনসাস মাইন্ডের। সাবকনসাস মাইন্ডের হিস্ট্রি দেখেন আপনি। কতো হাজার বছরের! আপনি এটাকে পাল্টাতে চাইলেও পাল্টাতে পারবেন না। চাইলেও আপনার ফেবারে আনতে পারবেন না।

দুটো উদাহরণ দিই। আমরা যেকোনো রেফারেন্সে বৃটিশদের শাসনামল নিয়ে কথা বলি; অথবা মোগলদের। এর আগে আমাদের কোনো ইতিহাস নেই, না? এর আগে আমাদের কোনো বাস্তবতা নেই? গত ২,০০০ বছরের ইতিহাসে মোগলরা ছিলো ৫০০ বছরের নিচে। আমি রায়হান রাইন-এর ‘বাংলার দর্শন : প্রাক্-উপনিবেশ পর্ব’ বইটার রেফার করে কথা বলছি আপনাকে। উনি এখন পরের বইটা লিখছেন। আপনি ওইটাকে রেফার করে চিন্তা করে দেখেন, ২,০০০ বছরে সাবঅলটার্ন কনসাসের ফিলোসফিকাল বিবর্তনটা দেখেন, তাহলে বুঝতে পারবেন আপনি কোথা থেকে কোথায় আসছেন। মানে ৩০ বছরের বেগমপাড়া, ২০০ বছরের ইংরেজ রিয়ালিটি বা ৫০০ বছরের নিচের মোগল রিয়ালিটিই কেনো আমাদের রিয়ালিটি?

আপনার এইখান থেকে বগুড়া কতোদূর? কয় কিলোমিটার? আপনি বগুড়ার ইতিহাস কতোটুকু জানেন? সোমপুর বিহারের ইতিহাস আমরা কেনো জানি না? আমাকে কেনো ভুলিয়ে রাখা হয়েছে সোমপুর বিহারের ইতিহাসটা? আপনাকে আমাদের এখানকার আর্কিটেকচারের উদাহরণ দিয়ে বলি, আমাদের এখানে যতো মহৎ আর্কিটেকচার আছে মোগল পিরিয়ডের, সেগুলো তো বিশাল! বুলন্দ দরওয়াজা। ভারতের ফতেহপুর সিকরি’তে আকবরের যেকোনো একটা যুদ্ধ জয়ের পরের ঘটনা এটা, আপনি গুগলে সার্চ করলে পাবেন। বিশাল! কী অসাধারণ! ফতেহপুর সিকরির আর্কিটেকচারটা দেখেন আপনারা, কী অসাধারণ আর্কিটেকচার! কারা বানিয়েছে? কে বানিয়েছে? ইউরোপ থেকে পড়াশোনা করে এসে বানিয়েছে, ক্যামব্রিজ থেকে পড়াশোনা করে এসে এইগুলো বানিয়েছে, কে বানিয়েছে, খোঁজ নিয়ে দেখেন, এখানকার মাদ্রাসায় পড়া ছেলেপেলেরাই এগুলো বানিয়েছে। তাহলে মাদ্রাসায় কী শুধু ধর্মই পড়ানো হতো? যদি ধর্মই পড়াতো, তাহলে এই পরিমাণ জিওমেট্রি, এই পরিমাণ আর্কিটেকচার, এই পরিমাণ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, এই পরিমাণ ম্যাথমেটিক্স, এই পরিমাণ সায়েন্স কেমনে পড়লো ওরা? দোয়া পড়া পানি দিয়ে দিয়েছে নাকি! না, কিন্তু আপনি তো আমাকে তাই শেখালেন। মানে আপনি বলতে আমি বোঝাচ্ছি আমাকে যারা হিস্ট্রি শেখাচ্ছে। আপনারা তো আমাকে এইটাই শেখালেন। যে আমার সাবকনসাস বলে কিছু নাই। আমি যা শেখাবো তুমি তাই। এটা তো আপনি আমাকে এইজন্য শিখিয়েছেন যে, এটা করলে আপনার সুবিধা হবে আমাকে নিয়ে প্যাকেজ বানাতে।

এখন আমি যদি আমার দেশের ভিত্তিতে চিন্তা করি, আপনার সাবকনসাসে ব্যাক করি যে, কেন্দ্র শেখাচ্ছে কেন্দ্রই সত্য। পরিসীমা মিথ্যা। এটা পরিসীমার গল্প। পেরিফেরির গল্প। পেরিফেরি তো কেন্দ্রকে চিনেই না। ২১ শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আমরা যারা বসে আছি, ২১ শে ফেব্রুয়ারি কী এটা তো তারা জানেই না। ১৬ ডিসেম্বর সম্পর্কে জানেই না। ও আচ্ছা ওটা কী জানি! ও বাজার করতেছে, ওর নৌকা আসবে, ধাম ধাম মাটি কাটবে। ওর রিয়ালিটি কী? এগুলোই আপনার কন্সট্রাক্টটেড রিয়ালিটি। এগুলো আমাদের মধ্যে কিছু পুতুপুতু ভদ্রলোক আছে—এটা খুবই সুন্দর, একটা ফ্রেজ শিখছি আজকে, পুতুপুতু ভদ্রলোক বললেন না কে—ওই পুতুপুতু ভদ্রলোকদের রিয়ালিটি এগুলো। এবং সেই রিয়ালিটিই আপনি আমি এই কোট আন কোট চাষাকে শিখিয়েছি। একজন চাষাও চায় তার ছেলে চাষা না হোক। কামারও চায় তার ছেলে কামার না হোক। কুমারও চায় তার ছেলে কুমার না হোক। এইটা কোথা থেকে আসছে? কেমনে শেখালেন তাদের এটা? এইভাবেই তো শিখিয়েছেন। কারণ আপনি ওরে কন্টিনিয়াসলি বলছেন, ইউ আর নাথিং। নো ওয়ান। তুমি নোবডি। রাষ্ট্র আপনাকে বলছে, ইউ আর নো ওয়ান, নোবডি। প্রতিটা ইন্সটিটিউশন মাত্রই কোয়ার্সিভ। স্ট্রাকচার মাত্রই কোয়ার্সিভ। এটা সাবঅলটার্নের কনসাসকে ডিনাই করেই অ্যাগজিস্ট করে। তবে এই সাবঅলটার্ন কনসাস তার ওপর বেইজড করে অ্যাগজিস্ট করে না। দ্যাট ইজ দ্য মোস্ট ইম্পরট্যান্ট পাওয়ার অব দ্য সাবঅলটার্ন কনসাস। থ্যাঙ্ক ইউ সবাইকে [দর্শকের করতালি]।

 

কামার আহমাদ সাইমন

https://www.facebook.com/film.kamar.simon

 

টীকা

১. কেউ চাইলে জে এন ইউ-এর রুহিত ভেমুলা’র পুরো সুইসাইড নোটটা পড়তে পারেন এখানে। লিঙ্ক :  http://timesofindia.indiatimes.com/articleshow/50634646.cms?utm_source=contentofinterest&utm_medium=text&utm_campaign=cppst; retrieved on: 12.12.24

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন